মরহুম আবুল হোসেন এবং মরহুমা হাজেরা খাতুন সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া পুর্ব পাড়া নিবাসী ছিলেন। তাঁদের দুই পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের একজন হলেন মোসাম্মদ মাহেলা বেওয়া। লেখাপড়া শেখা হয়ে ওঠেনি। নাম সই করাও জানেন না। বাবা কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতেন। তাঁর বড় ভাইও একই কাজ করতেন। যুদ্ধের দুই বছর পরে আব্দুল বাতেনের সাথে মাহেলার বিয়ে হয়। আব্দুল বাতেনের বাড়ি ছিল কল্যাণীপুর গ্রামে। সেখানে তাঁর কোন জমি জমা বা বাড়িঘর ছিল না। আব্দুল বাতেনের পিতা মারা যাওয়ার পর মাহেলা বেওয়ার নানি তাঁকে নিজের কাছে রাখেন, পালেন। এরপরই মাহেলা বেওয়ার সাথে আব্দুল বাতেনের বিয়ে হয়। ঘরজামাই হিসেবেই থাকতেন তিনি। কখনও কৃষি কাজ কখনও রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করে মোটামুটি ভাবে সংসার চালাতেন।
যুদ্ধের সময় মাহেলা বেওয়ার বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল। তাঁরা শ্বশুরবাড়ি ছিলেন। মাহেলার মা তাঁর অন্য দুই ভাইকে নিয়ে লাঙ্গলমোড়া গ্রামে মাহেলার ফুফুর বাড়িতে ছিলেন। মাহেলা বেওয়া তাঁর স্বামী ও পিতার সাথে বাগবাটি গ্রামে পালিয়ে ছিলেন। এর তিন চার দিন পর মাহেলার বাবা সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে এসে জানান যে নিমগাছির দিকে মিলিটারিরা এসেছে। মাহেলার মায়েদের কি অবস্থা তা নিয়ে উনি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। ভেবেছিলেন হয়ত মারাই গেছেন মাহেলার মা আর ভাইয়েরা। পাশের বাড়ির একজনকে মাহেলার বাবা বলে যান যেন মাহেলাকে নিজের মেয়ের মত করে দেখে রাখেন এই একটা দিন। তাঁরা কোথাও পালালে যেন মাহেলাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। লোকটিকে মাহেলা চাচা বলে ডাকতেন। মাহেলার বাবা চলে গেলে মাহেলারা বাগবাটিতেই পালিয়ে থাকেন। সেদিনই তাঁরা মাইকিং শোনেন যে অস্ত্র জমা দেয়ার কথা বলছে। যাদের কাছে অস্ত্র ছিল তাঁরা অস্ত্র জমা দেয়। কিন্তু সেসব অস্ত্র লুট হয়ে যায়। সেদিনই একটা উড়োজাহাজ এসে তাঁদের গ্রামে তিন জায়গায় বোমা ফেলে যায়। মাহেলারা মাটির নিচে পালিয়ে ছিলেন। সন্ধ্যার সময়ে তাঁরা শোনেন যে জেলখানায় আগুন দেয়া হয়েছে। খানিক বাদে তাঁরা জেলখানার দিক থেকে কান্নার আওয়াজও শুনতে পান। মাহেলার সেই আশ্রয় দাতা চাচা মাহেলাকে সাথে করে নিয়ে যান পালানোর সময় ঠিক যেমনটি তিনি মাহেলার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন। গ্রামের এক বড় বাড়িতে আশ্রয় নিলে সেই বাড়ির মালিক বলেন যে পাশের গ্রামে মিলিটারি এসেছে। বড় ঘরের পাশে একটা ঝুপড়ি ঘর ছিল সেখানে একজন বুড়ি থাকতেন। মাহেলাসহ যারা মহিলা ছিলেন তাঁরা ওই ঘরে আশ্রয় নেন। বুড়ি বলেছিলেন মিলিটারিরা এসে বড় ঘরে খাবে। এই ঘরে বুড়ি থাকে জানলে ওরা আসবে না। এই ঘরটিকে তাঁরা নিরাপদ ভাবলেও মিলিটারিরা আসলে ওদের সাথে থাকা রাজাকাররা এই ঘরটি ওদের দেখিয়ে দেয়।
মিলিটারিরা এসে মাহেলাসহ চারজনকে ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। মাহেলাকে উঠানোর সময় মাহেলা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার খুব চেষ্টা করেন। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ওরা মাহেলার হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। মাহেলা জানান সেই দাগ এখনও আছে। তাঁর গালেও কামড় দিয়েছিল ওরা। তখন ছিল মে মাসের মাঝামাঝি সময়। মাহেলার বয়স কেবল তের কি চোদ্দ। অপরিণত শরীরে যে নির্যাতন হয়েছিল মাহেলার তা সারাজীবনের ক্ষত হয়ে ছিল। সকাল এগারোটা থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত মাহেলার উপর উপর্যুপরি নির্যাতন করে মিলিটারিরা। নির্যাতনের প্রকোপে মাহেলা জ্ঞ্যান হারিয়ে ফেলেন। তাঁর পায়ুপথ ও যোনিপথ মিশে এক হয়ে যায়। এই ক্ষত তাঁকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়েছে যা তাঁর বৈবাহিক জীবনেও অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মাহেলার সাথে অন্য যাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁরা কেও বেঁচে ছিল না নির্যাতনের পর। মাহেলার বাবা মাহেলার খোঁজ করতে করতে পাঁচদিন পর খবর পেয়ে মাহেলাকে নিতে আসেন। মাহেলাকে নিয়ে তাঁরা ছাইনাতপুরে যান। ওখানে কিছুদিন থাকার পর মাহেলার শরীরের ক্ষতগুলি কিছুটা ঠিক হয়। কিন্তু মাহেলা পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে ওঠেননি তখনও। কোন কাজ করতে পারতেন না। কিছু করতে গেলেই কোমর ব্যাথা হত আর পেট ফুলে যেত। এভাবে এক দেড় বছর কাটার পর মাহেলা আর কোন উপায়ান্তর না দেখে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে যান। সেখানে তিনি দর্জির কাজ শেখেন। সেখানে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। বেতনও পেতেন। শেখা হয়ে গেলে তিনি সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপরই মাহেলার বিয়ে হয়।
বিয়ের পর মাহেলার সংসার খুব একটা সুখের ছিল না। তাঁর স্বামী তাঁকে ভালবাসতেন না। ভালো চোখে দেখতেন না। শরীরে বয়ে বেড়ানো নির্যাতনের চিহ্ন ছিল এর কারণ। তিনি তাঁর স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেছেন যাতে করে তাঁর স্বামী অসুখী না থাকেন। আব্দুল বাতেন আবারো বিয়ে করেন। দুই বউকেই খাওয়া পরা দিতেন। তবে বেশিরভাগ সময়েই দ্বিতীয় বউয়ের কাছে থাকতেন তিনি। আব্দুল বাতেন অসুস্থ্ হয়ে তিন বছর বিছানায় পরে থাকেন। তখন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। আব্দুল বাতেন আবার মাহেলার কাছে ফিরে আসেন। এসময় মাহেলার মা- বাবাও মারা যান। রাহেলা সন্তানাদি নিয়ে দিনযাপন করতে থাকেন। বছর বারো আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। বর্তমানে মাহেলা তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে থাকেন। মাঝে মাঝে একটু আধটু দর্জির কাজ করে কোনমতে সংসার চালান। সেই পেট ও কোমরের ব্যাথায় এখনও ভোগেন। সমাজের মানুষজনের মনোভাব কি জানতে চাইলে তিনি জানান যে কেউ তাঁর মত বীরাঙ্গনাদের ভালো চোখে দেখে না। তরুণদের কেউ ভালো তো কেউ খারাপ বলে।
এই বীরাঙ্গনার খেতাব তাঁদের কোন কাজে আসে না বলে জানান। মাঝে মাঝে মানুষজন ছবি তুলতে আসে, সাক্ষাতকার নেয়। কেউ টাকা দেয়, বিভিন্ন সাহায্য দেয়। মাহেলা এরকম সাহায্য খুব বেশি পাননি। একবার কম্বল, চাদর আর কাপড় পেয়েছেন। মাহেলা অভিযোগ জানান, এই স্বাধীন বাংলাদেশের অসঙ্গতি তুলে ধরেন যেখানে রাজাকাররা বড় বিল্ডিংয়ে থাকে, আর মুক্তিযোদ্ধারা থাকার জায়গা পায় না। সরকারি জায়গায় খাল-পাড়ে ঘর তুলেছিলেন মাহেলা। ২০০৭ সালের তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সেই ঘর ভেঙ্গে দিয়েছে সরকার। কিস্তিতে টাকা তুলে এখন একটা ঘর তুলে থাকছেন মাহেলা বেওয়া। সরকারের দিকে মুখ চেয়ে আছেন, তাঁরা যদি কিছু করে!
লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো