রাহেলার নাম বীরাঙ্গনার খাতায় ওঠল বটে, তবে তাঁর স্বামী তাঁকে আর ঘরে নিল না। নির্যাতনের পর রাহেলা যখন তাঁর বাপের বাড়ি তখন তাঁর স্বামী আকবর শেখ একদিন সেখানে আসেন। তিনি সবকিছু শুনেই সেখানে আসেন। এলাকায় এসে লোকমুখে আরো নানা কথা শুনেন। রাহেলা তখন স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি যেতে চান কিন্তু স্বামী নিতে নারাজ। আকবর শেখকে বুঝিয়েও রাহেলাকে সঙ্গে দেয়া গেল না। আকবর শেখ রাহেলাকে তাঁর বাপের বাড়িতে রেখেই চলে যান। আবারো কপাল ভাঙল রাহেলার। দেশ স্বাধীন হবার পর সব মানুষ ঘরে ফিরে গেল কিন্তু রাহেলার আর ঘর ফেরা হল না।
সেই সঙ্গে সামাজিক অবহেলা তো ছিলই। প্রান্তিক মানুষ হবার কারণে হয়তো রাহেলাদের ওপর সেই অবহেলার দায়টা বেশি পড়েছে। সামাজিক-আর্থিক কাঠামোই যেন রাহেলাদের জীবনকে আরো বিষময় করে তুলে। সেই দায় থেকে রাহেলা আজও মুক্ত নন। তিনি তাঁর কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। পরিবারের সদস্যরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা যখন রাহেলা বেওয়ায় বাড়ি পৌঁছি তখন দুপুরের রোদ মাথায়। রাহেলা বেওয়া নিজের সংসারের কাজ গুছাচ্ছিলেন। হাঁসগুলো পুকুরে গিয়ে কোথায় চলে গেছে ক্ষণে ক্ষণে সেই খবরও নিচ্ছেন, এদিকে হাঁড়িতে ভাত ফুটন্ত। আগেই শুনেছিলাম রাহেলা বেওয়ারা দুই বোন বীরাঙ্গনা। পাশাপাশি আরো কয়েকজন থাকেন। সকলের সঙ্গেই কথা বলব বলেই সেখানে যাই। রাহেলা বেওয়ার টিনের ঘরেই বসি। দুই রুমের ঘর। একরুমে ছেলেমেয়েরা বসে টিভি দেখছে। এপাশের রুমে আমরা বসি। মাঝখানে চাতালের বেড়া। কিন্তু রাহেলা বেওয়া আমার সঙ্গে কথা বলতে কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ করছিলেন। পরে জানালেন, পাশের রুমে ছেলেমেয়েরা রয়েছে তারা চায় না তাদের মা এ বিষয়ে কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করুক। তবু আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না রাহেলার জীবনের গল্পটা শুনতে।
রাহেলা বেওয়ার জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার বাজার বদরঘাট গ্রামে। তিনি ঠিক কত সালে জন্মগ্রহণ করেন তা বলতে পারেন না। তিনি অনুমান করেন তাঁর বয়স এখন পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। রাহেলার বাবার নাম আবুল হোসেন তালুকদার, মায়ের নাম হাজেরা খাতুন। রাহেলার দাদা পারিবারিকভাবে বেশকিছু জমি-জমার মালিক ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন মানসিক রোগী। ফলে সেসব সম্পদ তিনি আর ধরে রাখতে পারেননি। তিনি মারা যাবার পর আবুল হোসেন তালুকদার পরিবার নিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের ধানগড়ায় চলে আসেন। তখন রাহেলার বয়স মাত্র এক দেড় বছর। সেখানে আবুল হোসেনের কিছু জমি-জমা ছিল। কিন্তু পরে আর তা ধরে রাখা যায়নি। রাহেলারা দুই ভাই ও তিন বোন। রাহেলা সবার বড়। রাহেলার স্কুলে যাবার সুযোগ হয়নি। তিনি অক্ষর-জ্ঞানহীন। ছেলেবেলায় তাঁকে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতে হয়েছে। বাকি সময়টা তিনি মাকে রান্না-বান্নার কাজে সহযোগিতা করেছেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা যেরকম হয় রাহেলার ছেলেবেলাকার জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়।
‘মুজিব যে সনে ভোটে দাঁড়ান সেই সনে’ অর্থাৎ সত্তরের নির্বাচনের এক বছর চার মাস আগে রাহেলার বিয়ে হয়ে যায় সিংনাথপুরের আকবর শেখের সঙ্গে। তখন রাহেলার বয়স কত তা তিনি বলতে পারেননি। তবে তিনি তখন ‘বিয়ের যোগ্যি’। রাহেলার স্বামীর বাড়ির অবস্থা ছিল ‘খেয়েপড়ে বাঁচার মতো’। আকবর শেখ মূলত কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। রাহেলার বাবা আবুল হোসেন বিয়ের পরও মেয়েকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেন। কিছুদিন রাহেলা স্বামীর বাড়ি সিংনাথপুরে থাকার পর তাঁর বাবা আকবর শেখকে ঘরজামাই করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। রাহেলা ও আকবর দম্পতির ছয় মেয়ে ও দুই ছেলে। পাঁচ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে বিয়ের পর মারা গেছেন। ছোট মেয়েটা এখন স্কুলে পড়ে। স্বামী আকবর শেখ মারা গেছেন প্রায় সাত বছর। ফলে রাহেলাই এখন সংসারের কর্ত্রী। বড় ছেলেটা ‘কেলাস নাইন পর্যন্ত পড়ি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে। ছোট ছেলেটা হাফেজ পর্যন্ত পড়ছে, এখন বাসের কন্ট্রাকটারি করে।’ তাদের সামান্য আয়ে রাহেলা সংসার চালাতে হিমসিম খান। ফলে এই বয়সে এসেও রাহেলার নিজেকে উপার্জনের কথা ভাবতে হয়। ধানগড়ার যে বাড়িটিতে এখন রাহেলা বেওয়া থাকেন সেই বাড়িটি সরকারী খাস জমির ওপর। বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়েই এখানে ঘর তৈরি করেছেন রাহেলা।
রাহেলার দুঃখ দেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এখন প্রতিমাসে ভাতা পাচ্ছেন, অনেকে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও নানা সরকারী-বেসরকারী সুবিধা ভোগ করছেন। কিন্তু বীরাঙ্গনারা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাঁর প্রত্যাশা, তাদের মতো যারা অসহায় দরিদ্র বীরাঙ্গনা আছেন তাদেরকে যেন সরকার সেই সুবিধা প্রদান করেন। তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে একথাও জানান, বিভিন্ন সময়ে তিনি ও তাঁর মতো আরো অনেকেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহযোগিতা পেয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিও নানাভাবে তাদের সহযোগিতা করে থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় রাহেলা ও তাঁর পরিবার শহরেই ছিল। সেখানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আসার পর রাজাকারদের সহায়তায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিত কোন পরিবারের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গেছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিক থেকে অবশ্য কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধাও শহরে গেরিলা বেশে ঢুকতে শুরু করে। তারা নানাভাবে শহরে রেকি করত। অপারেশনের খোঁজ-খবর করত। একদিন বেশ কয়েকজনের মুক্তিযোদ্ধার দল স্থানীয় খোকসাবাড়িতে অপারেশনে যাবার পথে রাহেলাদের বাড়িতে উঠেছিল। রাহেলার মা তাদেরকে রুটি মুড়ি চা পানি দিয়ে সাধ্যমতো যত্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সিরাজগঞ্জ শহরে ‘মিলিটারির উৎপাত’ বেড়ে যায়। রাহেলার পরিবার যে স্থানে থাকত সেখানে একদিন তিনটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা। তখন আকবর শেখ তাঁর পরিবারকে গ্রামের বাড়ি সিংনাথপুরে পাঠিয়ে দেন। রাহেলার বাবা-মা তখন শহর থেকে ভূঁইয়াগাতির লাঙ্গলমোড়ায় তাঁর ফুফুর বাড়িতে চলে যান।
কয়েকদিনের মধ্যেই সিংনাথপুরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাজাকার আলবদরদের সহযোগিতায় চলে আসে। এসেই তারা সেখানে গ্রামে ও আশেপাশে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ চালায়। রাহেলার শ্বশুর বাড়ির পাশের বাড়ি থেকে দুইজন নারী ও দুইজন পুরুষকে কয়েকজন পাকসেনা ধরে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে একজন ছিল সদ্য প্রসূতি। নির্যাতনের মুখে সে সেখানেই মারা যায়। অন্যজন নির্যাতনের মুখেই পাশের নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। কিন্তু বাড়ির পুরুষ দুজনকে ধরে পাশের গ্রাম হামকুড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক আম বাগানের গাছে পিঠমোড়া করে দুজনকে রশি দিয়ে বেধে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রাহেলার শ্বশুর বাড়িতে তখন কান্দাপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা সোহরাবের বোন ও মা ছিল। বাড়িতে রাহেলার ননদসহ আরো কয়েকজন নারী ছিল। গ্রামে যখন পাক হানাদার বাহিনী এই নৃশংস হত্যা চালাচ্ছে তখন রাহেলারা সবাই বাড়ির পাশে এক বড় বেতের আড়ার মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। এইভাবে বেশ কয়েকদিনই তারা বেতের আড়ার মধ্যে দিন যাপন করেন। তাদেরকে দিনের বেলায় সেখানে রেখে দেয়া হত আর রাত্রে করে বের করা হত। এই অবস্থার মধ্যেই একদিন রাহেলার বাবা এসে তাঁকে নিয়ে যান লাঙ্গলমোড়ায়। সেখানে ‘মিলিটারির উৎপাত’ কিছুটা কম ছিল।
কিন্তু সেখানেই একদিন পাকিস্তানী সেনারা হানা দেয়। গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী আসছে শুনে রাহেলাকে তাঁর বাবা পাশের এক হিন্দু বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সে বাড়িতে লুকিয়ে থাকার বেশ কিছু গোপনীয় জায়গা ছিল। আরো কয়েকজন নারী ছিল সে বাড়িতে। রাহেলা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ তখন নদী পাড়ের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। কিন্তু রাহেলাসহ ওই বাড়ির আরো দুই নারী জঙ্গলে না গিয়ে বাড়িতেই লুকিয়ে থাকেন। পাকিস্তানী হানাদাররা যথারীতি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে লুটপাট করে রাজাকারদের সহযোগিতায় নদীর পাড়ের জঙ্গলে তল্লাশি করা শুরু করে। সেখান থেকে অনেক নারীকে ধরে নিয়ে নদী পাড়েই তাদেরকে নির্যাতন করা হয়।
রাহেলা যে হিন্দু বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন সেখানেই রাজাকাররা হানাদারদের নিয়ে আসে। এসেই ওই বাড়ি তল্লাশী করে দু’জন নারীকে টেনে হিচড়ে বের করে আনে। তাদের একজন ছিল বৃদ্ধা একজন যুবতী। দুজনকেই হানাদাররা নির্যাতনের মুখে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। রাহেলা তখনো একটি দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা খুব বেশিক্ষণ টেকেনি। তিনিও ধরা পড়ে যান পাকিস্তানী ঘাতকদের হাতে। আর তারপরই রাহেলার ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। রাহেলার কপাল ভাঙে।
তখন বিকেল গড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যার দিকে। নির্যাতনের পর হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা তিনজনকেই একটি কলের পাশে বসিয়ে রেখে যায়। সন্ধ্যার পর রাহেলার বাবা তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আনেন। কিন্তু আবুল হোসেন তালুকদার মেয়েকে সেই গ্রামে না রেখে পাশের এক গ্রামে নিয়ে যান। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর আবার তারা আবুল হোসেনের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান।
দেশ স্বাধীন হবার পর নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য সারাদেশে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলা হয়। সিরাজগঞ্জেও এর শাখা খুলে সেখানে নির্যাতিত নারীদের নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে সেখানে নানারকম কর্মমুখী শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। রাহেলাও সেখানে যান। প্রায় তিন বছর সেখানে কাজ করেন। সেখানে যাওয়া ছাড়া রাহেলার আর কোনো পথও ছিল না। স্বামী তাঁকে নিচ্ছে না। উপার্জন না করলে খাবেন কী? ফলে বাধ্য হয়েই তাঁকে উপার্জনের পথে নামতে হয়। কিন্তু রাহেলার বাবা প্রথমদিকে চাননি তাঁর মেয়ে সেখানে কাজ করুক। তিনি মেয়েকে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে নিয়ে যেতে চান। শেষ পর্যন্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে কথা বলে তাকে রাজি করান। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাহেলার ছোট বোন মাহেলা বেগমও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। বীরাঙ্গনা মাহেলা এখন রাহেলার পাশেই এক বাড়িতে থাকেন।
রাহেলা তখন পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকার পাশাপাশি মাঝে মাঝে বাপের বাড়িতে গিয়েও থাকেন। এভাবে মোটামুটিভাবে রাহেলার জীবন দু’বছর কেটে যায়। রাহেলা সিরাজগঞ্জ শহরে যেখানে থাকতেন তাঁর পাশেই রক্ষী বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। সেখানের একজন কমান্ডার রাহেলাকে ডেকে সব কথা জিজ্ঞেস করেন। রাহেলা তাঁকে সব কথা বলেন। তিনি তখন আকবর শেখকে বুঝান যেন রাহেলাকে ঘরে তুলে নেন। অনেক বুঝানোর পর আকবর শেখ রাহেলাকে ঘরে তুলতে রাজি হন। রাহেলা আবার আকবর শেখের সঙ্গে সংসার শুরু করেন। কিন্তু সে জীবনেও তিনি কম কথা শুনেননি, কম যন্ত্রণা পাননি।
রাহেলা বেওয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এটি প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০১০ সালের ১৭ জুন সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের পাশে ধানগড়া নামক স্থানে তিনি এই সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সাফিনা লোহানী।
লেখক : চন্দন সাহা রায়