রাজুবালা দে’র জন্ম হয় সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার চাঁদপুর গ্রামে। পিতা বটেশ্বর ও মা বুচির ৪ সন্তানের একজন ছিলেন রাজুবালা দে। যুদ্ধের ৪/৫ বছর আগে টাঙ্গাইলের হরিপদ দে’র সাথে বিয়ে হয় রাজুবালার। লেখাপড়া শেখা হয়ে ওঠেনি। শুধু নাম সই করতে পারেন। চার ভাইবোন সকলে মিলে পিতামাতার সাথে শীতল পাটির কাজ করতেন। হরিপদ দে-ও শীতলপাটির কাজ করতেন। এর থেকে ভালো আয় হত দেখে তিনি সিরাজগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন পুরো পরিবার নিয়ে। একসাথে কাজ করে মোটামুটি ভালোই আয় হচ্ছিল তাঁদের। যুদ্ধের সময়ও তাঁরা এই গ্রামেই ছিলেন। রাজুবালার বয়স তখন উনিশ কি বিশ। পাকবাহিনীর ভয়ে দুই মেয়ে তিন ছেলে নিয়ে ঝোপে জঙ্গলে, কখনও কখনও মাটিতে গর্ত করে তাতে লুকিয়ে থাকতেন। বিমান আসার শব্দ শুনলেও মাটির নিচে আশ্রয় নিতেন। ছেলেপেলেদের বুঝ দিয়ে শান্ত রাখার জন্যে গুঁড় কিনে রেখেছিলেন। পাকবাহিনী আসলে পালাতেন, আর চলে গেলে ঘরে ফিরে রান্না বসাতেন। এভাবেই দিন কাটছিল।
রাজুবালা দে’র স্বামী সেদিন বাঁশ কাটছিলেন উঠানে বসে। হঠাৎ কয়েকজন মিলিটারি এসে উঠানে হাজির হলে হরিপদ দে পালাতে উদ্যত হন। হাতের ইশারায় রাজুবালাকেও পালাতে বলেন। মিলিটারিরা হুঙ্কার দিয়ে উঠে, ‘এ তু পালাস কেন, দাড়া, তোকে শুটিং করব, তোকে মাইরা ফালাব।’ রাজুবালা দে মেয়েকে কোলে নিয়ে অন্য কাঁখে ভাতের পাতিল নিয়ে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করেন। এক মিলিটারি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পাশেই একটা টিউবঅয়েলের পাড়ে একটা পুরাতন কুয়া ছিল। রাজুবালা দে সেখানে আছড়ে পড়েন। মেয়ে তাঁর শরীরের নিচে পড়ে। সেখান থেকে উঠে আবার পালাতে গেলে মিলিটারিরা তাঁর কোল থেকে মেয়েকে ধরে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মেয়ের মাথা মুখ সব ফেটে যায়। রাজুবালা দে’র শ্বশুর শাশুড়ি সবাই ওখানেই ছিলেন। তাঁরা মিলিটারিদের পায়ে ধরেন। রাজুবালাকে ছেড়ে দিতে কাকুতি মিনতি জানান। মিলিটারিরা সে কথা কানেও তোলে না। তারা রাজুবালাকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায়। তিনজন মিলিটারি পালাক্রমে রাজুবালাকে ধর্ষণ করে। আশেপাশের মানুষজন যার যার মত পালিয়ে গেছে ততক্ষণে। সন্ধ্যার পর হরিপদ ছাড়া পেয়ে রাজুবালাকে খুঁজতে আসেন। জঙ্গল থেকে অচেতন অবস্থায় রাজুবালাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসেন। তিনদিন পর্যন্ত রাজুবালার জ্ঞান আসেনি। এসময় কোন ডাক্তার পাওয়া যায়নি। অচেতন রাজুবালাকে নিয়ে স্বামী হরিপদ মাটির গর্তে লুকিয়ে থাকতেন।
ঘটনার আগের দিন মিলিটারি আসার খবর শুনে রাজুবালা ছেলেমেয়ে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করলে মিলিটারি আর রাজাকারদের সামনে পড়ে যান। ওরা রাজুবালাকে বলেছিল যেন না পালায়। অভয় দিয়েছিল। রাজুবালাও সরল মনে কথা বিশ্বাস করে থেকে গিয়েছিলেন। ভাত বসিয়েছিলেন চুলায়। সেদিন যদি এটা না ঘটত তাহলে হয়ত এমন নির্যাতনের শিকার হতে হত না রাজুবালাকে।মাটির গর্তে তিনদিন থাকার পর রাজুবালার জ্ঞান ফেরে। এর মাঝে কোথা কোথা থেকে হরিপদ দে ওষুধ জোগাড় করে এনে রাজুবালাকে খাইয়েছেন। সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে রাজুবালার ঘুম ভাঙ্গে। কপালে মুখে ক্ষতের দাগ। শুধু যে তাঁকে ধর্ষণ করেছে তাই নয়, শরীরে আঘাতও করেছে। মুখে ঘুষির দাগ, শরীরের নানা জায়গায় ঘা হয়ে গেছে। রাজুবালার শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁকে ঘৃণা করত। হরিপদ বলতেন, রাজুবালার তো দোষ নেই এতে, ও তো নিজের ইচ্ছায় নির্যাতিত হয়নি। শ্বশুর- শাশুড়ি রাজুবালাকে দেখতে না পারলেও হরিপদ তাঁর যত্ন করতেন। তিনি কখনও ঘৃণা করেননি রাজুবালাকে। রাজুবালাকে ত্যাগ করেননি।এই ঘটনার জন্য যতটা না মিলিটারিরা দায়ী তাঁর থেকেও রাজাকাররা বেশি দায়ী বলে মনে করেন রাজুবালা দে। তারা আগের দিন পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল মিলিটারিদের। নির্যাতনের দিনও তারা সাথে ছিল। যুদ্ধের পর এসব রাজাকাররা মারা গেলেও যতদিন বেঁচে ছিল খারাপ ব্যবহার করেছে। তাঁদের সন্তানরা এখন ভালোই আছে।যুদ্ধের পর পর হামিদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা রাজুবালাকে সিরাজগঞ্জে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যান। ওখানে তারা বিভিন্ন কাজ করতেন। মোটামুটি ভালোই ছিলেন তখন রাজুবালা। কিন্তু কিছুদিন বাদে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়।যুদ্ধের অনেককাল বাদেও সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে দিনযাপন করতে হচ্ছে রাজুবালাকে। সমাজের লোকে বীরাঙ্গনা বলে গালি দেয়। মেয়ে জামাইয়ের কাছে মুখ দেখাতে পারেন না। নাতি-নাতনিরা তাঁকে জিজ্ঞেস করে যুদ্ধের সময় মিলিটারিদের সাথে তিনি কি করেছেন। স্কুলে গেলে অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে এগুলো নিয়ে আলোচনা করে। রাজুবালা হিন্দু কায়স্থ, বীরাঙ্গনা বলে সমাজে অচ্ছুৎ। তিনি মন্দিরে যেতে পারেন না। লোকে বলে তাঁকে দিয়ে মন্দিরে পূজার কাজ করানো যাবে না।
কেউ কোন কাজ করতে দেয় না।রাজুবালা এখন একাই থাকেন। যুদ্ধের পর তাঁর স্বামী বরিশালে যাচ্ছিলেন সাদিবাবু নামক একজনের বাড়িতে রাসকিত্তনে। লঞ্চ থেকে হিন্দুদের ধরে ফেলে দিয়েছিল। হরিপদ তাঁদের মধ্যে ছিলেন। তাঁর লাশও পাওয়া যায়নি পরে। রাজুবালার ছেলে তাঁর কোন খোঁজ নেয় না। রাজুবালার সাংসারিক অবস্থা বেশ খারাপ। কায়স্থ মানুষ, মাছ-মাংস খান না। কলাসিদ্ধ আর ভাত খান, সেটাও ঠিকমতো জোটাতে পারেন না। তাঁর বয়স এখন ষাট/ বাষট্টি হবে। নানান বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছেন। প্রায়শই ওষুধ খেতে হয় নানান ব্যথায়। মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে কোনমতে দিনাতিপাত করছেন। গ্রামের একজন মাঝে মাঝেই সাহায্য করে। এই বীরাঙ্গনা খেতাবে মানুষের কাছে যতটা না সম্মান পান তাঁর থেকেও বেশি অসম্মানিত হন। এলাকার মানুষ বীরাঙ্গনা বলে গালি দেয়। খুব কম মানুষের কাছে সম্মান পেয়েছেন বীরাঙ্গনা হিসেবে। তরুণদের মাঝে কিছু মানুষ বোঝে। তবে বেশিরভাগই বীরাঙ্গনা বলে গালি দেয়। রাজুবালার সকল আক্ষেপ এই বীরাঙ্গনা পরিচয়ের উপর। তিনি মনে করেন সরকার তাঁকে এই পরিচয় দিয়েছে যখন এর প্রাপ্য সম্মানটুকুরও যেন ব্যবস্থা করে। তাঁদের ভালমন্দের দেখভাল যেন সরকার করে। তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। কোন অপরাধ তো করেননি। তাহলে কেন এত অপমান সইতে হবে। যোগ্য সম্মানটুকু তাঁর একান্ত কাম্য। সাথে বেঁচে থাকার একটু ভরসা। দাবীগুলো তাঁর সরকারের কাছে। সমাজের মানুষের কাছেও বটে।লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো