বেনীদুয়ার ধর্মপল্লী থেকে ঘুঘশি নদীর দূরত্ব আধুনিক কিলোমিটারের মাপে তিন কিলোমিটার। ঘুঘশি নদীর পাশের গ্রাম কাশিঘুটু। খ্রিস্টান ধর্মানুযায়ী বিয়ের জামাইকে সাজানোর বিশেষ রীতি ছিল। যার নাম Jaware horok। রীতি অনুযায়ী কনের পক্ষের লোকজন বরকে সাজাতে যেত। তো রীতি অনুযায়ী পড়শি গ্রামের ‘Jaware horok’ এ গেছেন বালক লুকাস মারান্ডী। জামাই সাজানো শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঘুঘশি নদীর খেয়াঘাটে দেখলেন এক অনাচার। প্রাইমারী স্কুলের ছোট ছোট ছেলেদের খেয়া পারাপারের পয়সা দিতে না পারার অপরাধে মাঝি মাঝ নদীতে তাদের উপর জুলুম করছে। পয়সা দিতে না পারায় বাচ্চাদের আবার এপাড়ে এনে নামিয়ে দিচ্ছে। এ ঘটনা দেখে বালক লুকাস মারান্ডী দৌড়ে ধামাইহাট থানায় গিয়ে দারোগার কাছে নালিশ করেন। তারপর দারোগা এসে মাঝিকে কয়েকটি চড় মেরে বাচ্চাদের বিনা পয়সায় খেয়া পার করে দিতে বললেন।
আরো একটি ঘটনা থেকে লুকাস মারান্ডীর বাল্যকালের সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ধামাইহাটে হাট করতে গেছেন তিনি। হাটের ভিড়ের মধ্যে হঠাত্ তাঁর দৃষ্টি পড়ে এক পকেটমারের উপর। লুকাস মারান্ডী দেখছেন সেই পকেটমার একটা গরিব লোকের পকেট থেকে টাকা নিয়ে সাথে সাথে তার সহযোগী পকেটমারের কাছে সেই টাকা পাচার করে দিচ্ছে। যে লোকটির টাকা পাচার করা হলো তিনি বুঝতে পারলেন সব কিন্তু পকেটমারকে কিছু বলার সাহস পেলেন না। চুপ করে থাকলেন। কিন্তু লুকাস মারান্ডী চুপ করে থাকলেন না, তিনি ঐ দুই পকেটমারের পিছু নিলেন। পরে হাট ভেঙে গেলে ঘুঘশি নদীতে অনেক লোকজন আর চৌকিদার নিয়ে ঐ দুই পকেটমারকে পাকড়াও করলেন তিনি এবং সেই টাকা গরিব লোকটির হাতে তুলে দিলেন।
ছেলেবেলা থেকেই মানবহিতৈষী ছিলেন লুকাস মারান্ডী। জীবনের পুরোটা সময় তিনি মানুষের সেবা করে কাটিয়েছেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় নিজের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে থাকেননি। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভেবে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে রুহিয়াতে ফিরে যেতে নিষেধ করলেও তিনি তা শোনেননি। মানুষের সেবার কাছে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছেন। আর তাই তো তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে।
১৯২২ সালের ১ আগস্ট বাবা মাথিয়াস মারান্ডী ও মা মারিয়া কিস্কুর প্রথম সন্তান হিসেবে বেনীদুয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লুকাস মারান্ডী। লুকাসরা ছিলেন দুই ভাই। ছোট ভাই পিতর ১৯৫২ সালে যক্ষ্মায় মারা যান। জাতিতে লুকাসের পরিবার ছিল সাঁওতাল। তাঁর জন্মের পরপরই তাঁর বাবা-মা ফাদার রক্কার দ্বারা দীক্ষা গ্রহণ করে নতুন খ্রিষ্টানরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর বাবা মাথিয়াস মারান্ডী একজন ভ্রাম্যমাণ কাটেখিট ছিলেন (পুরোহিত না হয়েও ধর্ম প্রচারকারী)।
জন্মের ৯ দিন পর ধর্মরীতি অনুযায়ী ফাদার গাইতান নরেন্স কর্তৃক দীক্ষা লাভ করেছিলেন লুকাস মারান্ডী। তারপর বাবা-মায়ের নিবিড় পরিচর্যায় মননশীলতার শিক্ষা লাভ করেছিলেন। আট বছর বয়সে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় বেনীদুয়ার মিশন প্রাইমারি স্কুলে। তখন থেকেই লুকাস মারান্ডী ফাদার গ্রাসির নৈকট্য লাভ করেন। মারান্ডীর সমগ্র জীবন জুড়েই ছিল ফাদার গ্রাসির প্রভাব। মূলত ফাদার গ্রাসির উত্সাহে লুকাস মারান্ডী শৈশবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণী শেষ করার পর ফাদার গ্রাসি তাঁকে তত্কালীন ভারতের শিলিগুড়ির বালুর ঘাট সরকারী স্কুলে পাঠান। সেখানে তিনি সাফল্য অর্জন করার পর ১৯৩৪ সালের শেষের দিকে ফাদার গ্রাসি দিনাজপুর সান্তাল মিডিল স্কুলে তাঁকে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন (যে স্কুলটি বর্তমানে সেন্ট ফিলিপস্ বোর্ডিং নামে পরিচিত)।
ঐ বছরই ফাদার গ্রাসি বেনীদুয়ার মিশন প্রাইমারি স্কুল থেকে বদলি হয়ে দিনাজপুর সান্তাল মিডিল স্কুলে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে বদলি হয়ে আসার কারণে লুকাশ মারান্ডীকে তিনি সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করার সুযোগ পান। ফাদার গ্রাসির ইচ্ছে ছিল লুকাস মারান্ডীকে সচ্চরিত্রবান করে গড়ে তোলা এবং ভবিষ্যতে যথাযথ সময়ে পুরোহিত হিসেবে অভিষিক্ত করানো। সেই উদ্দেশ্যে ফাদার গ্রাসি তাঁর প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। ‘সেন্ট ফিলিপস্ বোর্ডিং’- এ ফাদার গ্রাসি ছেলেদের জন্য সপ্তাহে একদিন পাপ স্বীকার ও মাসিক নির্জন ধ্যানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাছাড়া বাইবেলের খুব গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা হতো ফাদার গ্রাসি কর্তৃক। যার ফলে লুকাস মারান্ডী ছোটবেলা থেকেই একটি ধর্ম ও মানবতাভিত্তিক আদর্শের দিকে চালিত হচ্ছিলেন।
৬ষ্ঠ মানের (৬ষ্ঠ শ্রেণী) পর লুকাস মারান্ডী মিশন হোস্টেলে থাকতেন একজন শিক্ষানবীশ হিসেবে। পাশাপাশি ফাদার গ্রাসির সেক্রেটারির মতো কাজ করতেন। ফাদারের ইচ্ছায় তিনি তাঁর সারা দিনের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতেন। ফাদার গ্রাসির একান্ত সান্নিধ্যেই তাঁর মধ্যে পুরোহিত হবার ইচ্ছে জেগে উঠছিল। ফাদারের নির্দেশ মতো তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন। ফাদার গ্রাসিও তাঁকে যাচাই করার জন্য অল্প বয়সেই অনেক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কাজের দায়িত্ব মাঝে মাঝে দিতেন। এ দেশীয় ইতালিয় ফাদারগণের শিবিরগুলোতে লুকাস মারান্ডী খবরাখবর আদান প্রদান করতেন।
একদিন লুকাস মারান্ডী ফাদার গ্রাসি ও বিশপ আনসেলমোরকে তাঁর নিজের পুরোহিত হবার ইচ্ছের কথা জানালেন। তিনি মাধ্যমিক পাশ করে সেন্ট আলবার্ট (দক্ষিণ দিনাজপুর) সেমিনারিতে দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করছিলেন। ‘সেন্ট আলবার্ট’- এ দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা শিখানো হতো। লুকাস মারান্ডীর পুরোহিত হবার ইচ্ছের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বিশপ আনসেলমোর অনুভব করেন লুকাস মারান্ডীর শিক্ষার মান দুর্বল। পরে বিশপ আনসেলমোর তাঁকে ঐশ্বতত্ত্ব পাঠের জন্য ইতালিতে পাঠান।
ঐশ্বতত্ত্ব অধ্যয়ন ফাদার লুকাস মারান্ডীকে পুরোহিত হবার জন্য জ্ঞান ও নেতৃত্বের মানসিকতা এনে দিয়েছিল। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এসে মিশনের যুবকদের মধ্যে তিনি তাঁর জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেন। ‘পবিত্র দূত কাহিনী’ নামে একটি দল ছিল গ্রামে। এই সব দলের মিটিং তিনিই পরিচালনা করতেন। এভাবে যুবকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতের পুরোহিত লুকাস মারান্ডী। উপাসনার জন্য তিনি গীত রচনা করতেন। এসব গীত এর মর্ম কথা ছিল আত্মাকে শুদ্ধিকরণ। লুকাস মারান্ডী সাঁওতালী ভাষার লেখক ছিলেন। তাঁর উপাসনাদিও ছিল সাঁওতালী ভাষার। সাঁওতালী ধর্ম প্রশিক্ষক হিসেবেও তিনি কাজ করতেন। ঐ সম্প্রদায়ের লোকজন আসত তাঁর সাথে পরামর্শ নেয়ার জন্য। পরবর্তীতে তিনি সাঁওতালী সম্প্রদায়ের একজন নেতাও হয়েছিলেন।
১৯৫৩ সাল। লুকাস মারান্ডী একত্রিশ বছরের যুবক। ঐশ্বতত্ত্ব অধ্যয়ন শেষ করে দেশে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন পূরণের সন্ধিক্ষণ। যাজক হিসেবে তাঁর অভিষেকের মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়। মা-বাবা ও নিকট আত্মীয়দের উপস্থিতিতে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘দিনাজপুর ক্যাথিড্রাল’-এ বিশপ আবের্টের কাছে লুকাস মারান্ডী যাজক পদে অভিষিক্ত হন। আর ঐ দিনটা বিশপের জন্যও বিশেষ একটি দিন ছিল। কারণ তিনি বিশ বছর দিনাজপুর ধর্ম প্রদেশে বিশপ থাকা অবস্থায় একমাত্র ফাদার লুকাস মারান্ডীকেই অভিষিক্ত করতে পেরেছিলেন।
পুরোহিত হবার পর লুকাস মারান্ডীর প্রথম কর্মস্থল হয় বর্তমান দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার মারীয়ামপুর মিশন। সেখানে তিনি চার বছর কাজ করেছিলেন ফাদার সজ্জি ও মাজ্জনির সাথে। চার বছরেই তিনি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও নিম্নবর্গের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে সুনাম অর্জন করেন। পরে তাঁকে মারীয়ামপুর মিশন থেকে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্ট ফিলিপস্ বোর্ডিং’-এ আনা হয়। তখন তিনি বোর্ডিং- এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্যান্য খ্রীষ্টান গ্রামগুলোতে পালকীয় (খন্ডকালীন) কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আদেশ জারি করেন, দিনাজপুর ধর্ম প্রদেশের সব বিদেশিগণ যেন তাদের নিরাপত্তার জন্য ঢাকায় চলে যান। এই আদেশ জারি হলে সব বিদেশি ফাদারগন ঢাকায় আশ্রয় নেন। তখন দিনাজপুরে একটা সংকটের সৃষ্টি হলে ফাদার লুকাস মারান্ডী দিনাজপুর ধর্ম প্রদেশের অন্তবর্তীকালীন পরিচালকের দায়িত্ব নেন। ফাদার হয়েও তাঁকে বিশপের মতো কাজ করতে হতো। মানুষের মনোবল ঠিক রাখার জন্য তিনি ধর্মপল্লীগুলো ঘুরে বেড়াতেন। পাশাপাশি দিনাজপুর ধর্ম প্রদেশের পরিচালক হিসাবে সরকারের কাছেও জবাবদিহি করতে হতো। তখন তাঁকে প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের মধ্যে থাকতে হয়েছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবে তাঁর স্ট্রোক হয়। অবশ্য এক সপ্তাহ বিশ্রামের পর তিনি আবার সুস্থ হয়েছিলেন।
এরপরে তাঁকে বিশপ মাইকেল রোজারিও ‘সেন্ট ফিলিপস্ বোর্ডিং’ থেকে বদলি করে পালক (অস্থায়ী) পুরোহিত হিসেবে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়াতে নিযুক্ত করেন। সেখানে গ্রামগুলো ছিল অনেক দূরে দূরে। ঐসব দূর-দূরান্তের গ্রামগুলোতে তিনি নিরন্তর প্রচেষ্টায় ধর্মীয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সীমান্ত কাছে থাকায় রুহিয়ার গ্রামগুলোতে চোর-ডাকাতের ভয় ছিল আর সেখানের খ্রিস্টানরা ছিল নতুন দীক্ষিত। তারা সংখ্যায়ও ছিল খুবই কম। ৭০টির মতো গ্রাম ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সেখানকার মানুষ ছিল খুব গরিব। দুই একটা গ্রামে গির্জা ঘর ছিল। আর সেই ঘর ছিল ভাঙা আর ছোট ছোট। তবু হাল ছাড়েননি ফাদার লুকাস মারান্ডী। তাঁর মনে হতো এদের জন্যই বোধ হয় যিশু এসেছিলেন। তিনি তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। তিনি সেখানকার কৃষি উন্নতির জন্য দক্ষ নেতা নির্মাণের প্রয়াস চালাচ্ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে সেখানকার ছোট ছেলেদের জন্য একটি ছোট বোর্ডিং চালু করেছিলেন। বিশপ তাঁর আন্তরিক কাজ দেখে মুগ্ধ হন। পুরস্কার হিসেবে তাঁকে বিশ্রামের জন্য তিন মাসের ছুটি দিয়ে ইটালিতে পাঠান।
তিন মাস পর ইটালি থেকে রুহিয়াতেই ফিরে আসেন তিনি। জনরব উঠল যে, ফাদার মাজ্জনির সাথে কাজ করার জন্য ফাদার লুকাস মারান্ডীকে আন্ধারকোঠা মিশনে পাঠানো হবে। রুহিয়ার খ্রিস্টাভক্তগণ এই কথা শুনে তাঁরা বিশপ মাইকেলকে অনুরোধ করল, ফাদার লুকাসকে যেন তাদের মিশন থেকে বদলি করা না হয়। কারণ তাঁর যাবতীয় জীবনের মধ্যে রুহিয়ার খ্রিস্টানগণ প্রবক্তা (ঈশ্বর প্রদত্ত নবি) ‘দয়ালু শামরী’- এর আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পাচ্ছিল। পরে অবশ্য তিনি রুহিয়া মিশনেই থেকে গিয়েছিলেন।
রুহিয়াতে তাঁর একটা ডিস্পেনসারি ছিল। দূর গ্রামের লোকদের খুব প্রয়োজন হলে তিনি ঔষধ দিতেন। বেশ কিছুদিন ধরে ঔষধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১২ই এপ্রিল ফাদার মারান্ডী রুহিয়া থেকে নিজপাড়া মিশনের (বর্তমান দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থানায়) উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। উদ্দেশ্য ছিল দুটি। পূর্ণ বুধবারে নিজের পাপ স্বীকার করা ও ডিস্পেনসারির জন্য কিছু ঔষধ কেনা। নিজপাড়া মিশনে ছিলেন ফাদার কাভাঞা। ফাদার কাভাঞার কাছে তিনি কয়েকদিনের জন্য গায়াডাঙা মিশনে ঘুরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।
সীমান্ত তখন খোলা ছিল। ফাদার লুকাস মারান্ডী অস্থিরতা দূর করার জন্যই হয়ত ভারতের গায়াডাঙা মিশন থেকে ঘুরে আসার কথা বলেছিলেন ফাদার কাভাঞার কাছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ফাদার কাভাঞা অসম্মতি জানালেও পাস্কার (ইস্টার সান-ডের আরেক নাম) পরের দিন গায়াডাঙা মিশনে গেলেন লুকাস মারান্ডী। সেখানে থেকে পরদিন ইসলামপুর মিশনে গেলেন। ইসলামপুর মিশনে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের লোমহর্ষক খবরগুলো জানলেন। রুহিয়াতে থেকে ফাদার লুকাস মারান্ডী বুঝতে পারেননি এদেশের মানুষের উপর কী নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছিল পাকবাহিনী ও তার সহযোগী রাজাকাররা।
ভারতে যাওয়া তাঁর জন্য হিতে বিপরীত হলো। কারণ দেশের মানুষের কষ্টের কথা ভেবে তাঁর অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। তিনি রুহিয়াতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ইসলামপুরের ফাদারগণ তাঁকে ঝুঁকি নিয়ে ফিরে যেতে নিষেধ করলেও তিনি রুহিয়াতেই ফিরে আসেন তাঁর খ্রিস্টাভক্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন অভাব-অনটন আর জীবনের ভয়ে রুহিয়ার খ্রিস্টানরা ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোর উদ্দেশ্যে পালাতে শুরু করেছে। যারা এর মধ্যেই পালিয়েছে তারা গরু মহিষ ও অন্যান্য জিনিসগুলোও নিয়ে গেছে। মিশনে টাকা পয়সার অভাব। যদিও ব্যাংকে ছয় হাজার টাকা আছে কিন্তু তা আনা যাচ্ছিল না। তখন একদিন পিউশ দারেকান্ত নামের একজন ভক্ত এসে বললেন, ‘ফাদার, সবাই ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে, আমাদের এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না।’ সে দিনটা ছিল ২১ এপ্রিল ১৯৭১। দারেকান্তের সেই কথায় কান না দিয়ে তিনি বরং দারেকান্তের সাথে মিশনের আর্থিক দিক নিয়ে কথা বললেন। কিভাবে তাঁরা খেয়ে পরে দিনগুলো অতিবাহিত করতে পারে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনা শেষে পিউশ দারেকান্ত বাড়ি চলে গেলেন। কিন্তু এর পূর্বেই কিছু দুর্বৃত্ত পাকিস্তানী সেনাদের কাছে ফাদার লুকাস মারান্ডীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক নালিশ করে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে ফেলেছিল।
২১ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। বেলা বারোটা। ফাদার মিশনে বসেই দেখলেন সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি সড়ক বেয়ে রুহিয়ার বাজারের দিকে ছুটে গেল। এর ঠিক কয়েক মিনিট পর একটি গাড়ি মিশনের সামনে থামলো। চারজন সৈন্য গাড়ি থেকে নেমে ফাদারের কাছে ছুটে এসে বলল, তারা ফাদারের বাড়ি ঘর দেখতে চায়। সৈন্যরা ধারণা করেছিল অথবা তাদেরকে ধারণা দেয়া হয়েছিল মিশনে মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে। ফাদার লুকাস মারান্ডী সৈন্যদেরকে অফিস ঘর, শোবার ঘর এমনকি খাবার ঘরও দেখালেন। এরপর তিনি মিশনের বাবুর্চি সহিস দাসকে সবার জন্য চা তৈরি করতে বললেন। সহিস বাবুর্চি এসে জানতে চাইল কতজনের চা? তখন একজন সৈন্য বাবুর্চিকে চড় মারলে বাবুর্চি প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়। আর ঠিক তখনই সৈন্যদের একজন ফাদারের কানের নিচে গুলি চালায় এবং ফাদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জড়ো হয় সেখানে। যাজক শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডীর মৃতদেহ ভারতের ইসলামপুর মিশনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
এখনো রুহিয়া, মারিয়ামপুর আর বেনীদুয়ারের মানুষ যাজক হিসেবে ফাদার লুকাস মারান্ডীর শহীদ হওয়ার দিনটি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনিই ছিলেন তত্কালীন দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের প্রথম দেশীয় পুরোহিত। রুহিয়া মিশনে তাঁর স্মরণে ম্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। দিনাজপুর শহরের দক্ষিণে বেসরকারি সংস্থা ‘কারিতাস’ ‘শহীদ লুকাস মারান্ডী’ নামে একটি সড়ক নির্মাণ করেছে। বেনীদুয়ার মিশনে এখনও প্রতি বছর ২১ এপ্রিল তাঁর স্মরণে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। পাকিস্তানী হানাদারদের গুলিতে সেদিন ফাদার লুকাস মারান্ডীর মৃত্যু হলেও তিনি বেঁচে আছেন কোটি মানুষের মাঝে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
নাম : লুকাস মারান্ডী।
বাবা : মাথিয়াস মারান্ডী।
মা : মারিয়া কিস্কু।
শিক্ষা জীবন : বেনীদুয়ার মিশন প্রাইমারি স্কুল, বালুঘাট সরকারী স্কুল (তত্কালীন সময়ে শিলিগুড়ি অবস্থিত ছিল), সেন্ট ফিলিপস্ বোর্ডিং (দিনাজপুর)।
উচ্চ শিক্ষা : ইতালিতে ঐশ্বতত্ত্ব অধ্যয়ন।
পেশা : ধর্মীয় পুরোহিত।
মৃত্যু : ২১ এপ্রিল ১৯৭১ (পাকিস্তানী সৈন্যর গুলিতে)।
তথ্যসূত্র : সরাসরি সাক্ষাত্কার গ্রহণ – ফাদার হারুন হেমরম, বেনীদুয়ার মিশন, নওগাঁ এবং ফাদার আলফন্স মারান্ডী, দিনাজপুর মিশন; ফাদার হারুন হেমরমের লেখা বই – ‘শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডী’।
লেখক : কামরান পারভেজ