বীরাঙ্গনা শামসুন নাহারের মায়ের নাম আসমা, বাবা মোকাদ্দেছ আলী খান কৃষিকাজ করতেন। শৈশব কেটেছে দুই বোন এক ভাইয়ের সাথে বাবার বাড়ি আলোকদিয়ায়। পরে এক বোন মারা যান। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে শামসুন নাহার চলে আসেন চাচার বাড়িতে। সেখানে চাচার কাছেই বড় হন। স্বাক্ষর দিতে জানলেও কখনো লেখাপড়া শিখবার সুযোগ পাননি শামসুন নাহার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় তার আব্দুল মান্নান তালুকদারের সাথে।তেলকুপি গ্রামে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে থাকতেন। স্বামী মাটির কাজ করে যা আয় করতে তা দিয়ে দুজনের সংসার মোটামুটি চলে যাচ্ছিল, এর মধ্যে দেশে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ।
তখন গ্রীষ্মকাল, শামসুন নাহারের ভাষায় আম কাঁঠালের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে এমন সময়। গ্রামের রাজাকারদের কাছে থেকে তাঁরা আশ্বাস পেলেন যে মিলিটারীরা তাঁদের বাড়িতে আসবে না। রাজাকারদের কথা সরল মনে বিশ্বাস করে বসলেন দুজন। কিন্তু ধুরন্ধর রাজাকার আব্দুল ঐ দিনই বেলা ১১টার সময় পাকিস্তানি মিলিটারী নিয়ে শামসুন নাহারের বাড়িতে ঢুকল। তখন বাড়িতে শামসুন নাহার একা। তিন মিলিটারি মিলে শামসুন নাহারকে আক্রমণ করে বসলে শামসুন নাহারের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি চলল কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে মিলিটারীদের সহায়তা করতে সেখান যোগ দিল সেই রাজাকার আব্দুল। সে শামসুন নাহারকে চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে দিল। রাজাকার আব্দুলের সহায়তায় পাকিস্তানি মিলিটারীরা মিলে শামসুন নাহারের উপর চালাল পৈশাচিক নির্যাতন। শুধু তাই নয় পরবর্তীতে তারা পুড়িয়ে দিল তাঁর বাড়ি-ঘর। সন্ধ্যার সময় লোকজন এসে শামসুন নাহারকে উদ্ধার করে নিয়ে এল তাঁর নানীর কাছে, তিনি সেবা যত্ন করে সারিয়ে তুললেন শামসুন নাহারকে।
বীরাঙ্গনা শামসুন নাহারকে যখন নির্যাতন করা হয় তাঁর স্বামী আব্দুল মান্নান তখন ঘরে ছিলেন না, তবে নির্যাতনের পর স্বামী যে কোথায় চলে গেছেন তা বলতে পারেন না তিনি। শুধু লোকমুখে শুনেছেন যে স্বামী মারা গেছেন।যার একসময় ঘর ছিল, স্বামী ছিল, সংসার ছিল, দেশ স্বাধীনের পরে সেই শামসুন নাহারের সহায় হয় পুনর্বাসন কেন্দ্র। দেশ স্বাধীনের পর এই কেন্দ্রে সেলাইয়ের কাজ করে তিনি কোনমতে চলতেন। এভাবে একা একাই যুদ্ধ করে ১২ থেকে ১৩ বছর কাটান নিঃসঙ্গ জীবন । তারপর বিয়ে করেন তেলকুপি রহমতগঞ্জ কটন মিলের শ্রমিক শাহজান আলীকে। বর্তমানে তাঁর দুই ছেলে, বড় ছেলে আই.এ. পাশ করে ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে। ছোট ছেলেও নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে রাজমিস্ত্রি হয়েছে, তবে সে এখন মায়ের সাথে থাকে। ছেলেরা বড় হলেও অভাবের সংসারে এখনো জীবিকার তাগিদে শামসুন নাহার ঘুরে ঘুরে বাড়ীতে বাড়ীতে, দোকানে দোকানে কনডম বিক্রি করেন, সারাদিনে ৪০/৫০ টাকা যা আয় করেন তাই দিয়ে কোনোমতে দিন চালান। শামসুন নাহারের ভাষায় লোকজন তাঁকে তখনও খারাপ বলত এখনো খারাপ বলে। স্বাধীন দেশেও দু’দন্ড শান্তি নয় বরং প্রতিনিয়ত সমাজের সাথে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় তাঁকে।বীরাঙ্গনা শামসুন নাহার তাঁর শরীরে এখনো বহন করে চলেছে পাক পশুদের বুটের লাথি আর কাঁমড়ের ক্ষতচিহ্ন, গ্রামের এক বালিকা বধূ থেকে মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামী এক বীর, বীরাঙ্গনা শামসুন নাহার এখনো মনের কোণে লালন করে ন্যায়বিচারের আকাঙ্খা । সরকারের কাছে তিনি কিছু চান না চান শুধু ন্যায় বিচার।আর বাংলাদেশের মানুষের থেকে সামান্য একটু ভাল ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই তাঁর।
লেখক : সুমনা মঞ্জুর