সুরাইয়ার বিয়ে হয়েছিল যুদ্ধেরও আগে। যুদ্ধের সময় তাঁর দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটার জন্ম হয়েছিল ‘৭০ এর নির্বাচনের আগের দিন। দিনটা তাঁর মনে আছে। কারণ তিনি ভোট দিতে পারেননি। স্বামী শামসুল আলম মুহুরির কাজ করতেন। যুদ্ধের আগে তাঁরা সিরাজগঞ্জের পিটিআই স্কুল পাড়ায় থাকতেন। জজকোর্টে সংসার মোটামুটি ভালই চলছিল। যখন যুদ্ধ শুরু হল স্বামী শামসুল আলম সুরাইয়াকে ঘোড়াছাড়া গ্রামে নিয়ে যান। দু’মাস থাকার পর তারপর আবার সুরাইয়ার বাপের বাড়ি দোয়াতবাড়িতে চলে আসেন তাঁরা। এখানেই ছোটবেলা কেটেছে সুরাইয়ার, পিতা মরহুম আবুল চৌধুরী এবং মা মরহুমা আমিনার স্নেহ আর ভালোবাসায়। সুরাইয়ারা ছিলেন চার ভাই আর চার বোন। বাবার ফলের ব্যবসায় ভাইয়েরাও দোকানদারিতে সাহায্য করত।
যুদ্ধের সময় এই দোয়াতবাড়িকেই নিরাপদ মনে করেছিলেন সুরাইয়ার স্বামী। কোর্ট কাচারির চাকরি, চাকরিতে যোগ না দিলে আর চাকরি থাকবে না। লোকমুখে একথা শুনেই সুরাইয়াকে তাঁর বাপের বাড়ি নিয়ে আসেন শামসুল আলম। সুরাইয়ার পিতা আপত্তি জানিয়েছিলেন, মেয়ের জন্যে ভয় পেয়েছিলেন তিনি। সুরাইয়ার স্বামী বলেছিলেন কোন সমস্যা হবে না। নিজ বাড়ির পাশে জঙ্গলওয়ালা পুরাতন একটা জমিদার বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতেই তাঁরা পালিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন পাকবাহিনী সেখানে আসবে না। পাশে দুই ছেলে আর বুকের মাঝে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সুরাইয়া আর তাঁর স্বামী ভাঙ্গা বাড়িটিতে লুকিয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর স্বামীর ঘাড়ের কাছে বন্দুক ঠেকিয়ে ধরে পাকসেনারা। ঘর থেকে জোর করে ঠেলে বের করে দেয়। কোলের মেয়েটাকে বাড়ি দিয়ে সরিয়ে দেয় নিষ্ঠুর সেনারা। তারপর শুরু হয় সুরাইয়ার উপর নির্যাতন।
তখন সুরাইয়ার বয়স ছিল ২৩/২৪ বছর। বাবা ছিলেন বিহারি। উর্দুতে কথা বলতেন। পাকবাহিনীরা যখন তাঁদের গ্রামে আসে তখন আম কাঁঠালের সময় ছিল। তখনও কেউ ভাবতে পারেনি এই পাকবাহিনীরা কি কি করতে পারে। সুরাইয়ার উপর এই নির্যাতন নাও হতে পারত। বিহারী বলে পাকবাহিনীর সাথে একটা সূক্ষ্ম যোগাযোগ ছিল সুরাইয়ার পিতার। সুরাইয়ার ধর্ষণের পরে তাঁর পিতা তাঁকে এসে উদ্ধার করেন। পাকবাহিনীর সেনাদের তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর মেয়েকে তারা কেন নির্যাতন করলো! ঐ সেনারা সুরাইয়ার পিতার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। বলেছিল ওরা ভুল করেছে। বিহারীর মেয়েকে ওরা চিনতে পারেনি! এই ক্ষমা চাওয়া আর এই ভুল স্বীকার নির্মম পরিহাস মাত্র। হোক সে বিহারী, হোক সে বাঙ্গালী এই নির্যাতন কারো জন্যই কাম্য ছিল না। সকলের কাছেই তা ঘৃণ্য, বর্বরতা আর পৈশাচিকতার উদাহরণ মাত্র। পাড়ার লোকেরা কথা শোনাতে ছাড়েনি। সুরাইয়ার পিতা সুরাইয়ার স্বামীকে দায়ী করেছিলেন। দোয়াতবাড়িতে মেয়েকে না আনলে এ ঘটনা হয়ত ঘটত না। এক সুরাইয়ার পিতা একথা ভাবলেও তখনও চারিদিকে আরও সুরাইয়ার, সামিনার উপর নির্যাতন চলছিল।সুরাইয়ার পিতা আশঙ্কা করেছিলেন যে সুরাইয়াকে হয়ত তাঁর স্বামী আর মানবে না। মেয়েকে তাই নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সুরাইয়ার স্বামী বলেন যে এখানে সুরাইয়ার কোন দোষ ছিল না। তিনি সুরাইয়াকে ত্যাগ করবেন না। সুরাইয়াকে তাঁর স্বামী কখনই ছোট করেননি তাঁর পরবর্তী জীবনে। মনের ভিতর কষ্ট আর আক্ষেপ পুষে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে সুরাইয়ার কাছে কষ্টের কথা প্রকাশ করতেন।
যুদ্ধের পর নির্যাতিত নারীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হলে তিনি সেখানে যেতেন, কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের এই উদ্যোগকে তিনি মনে রেখে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। মুজিবুর রহমানের এই ভালোবাসা, সাহায্য- সহযোগিতা নিয়ে বাঁচার যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন সুরাইয়া তা অচিরেই কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যায়। শেখ মুজিব মারা যাবার সাথে সাথেই যখন পুনর্বাসন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় তখন সব আশা হারিয়ে ফেলেন সুরাইয়া।যুদ্ধের পর স্বামীর বাড়িতে থাকলেও নিজেদের জায়গা বলে কিছু ছিল না তাঁদের। নদীতে সব ভেঙ্গে গেছে ততদিনে। পিটিআই স্কুলের সামনে সরকারি খাস জমিতে কোনমতে ঘর তুলে থাকতেন। সমাজের লোকের চোখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হেয় চোখে দেখার পরিবেশে কষ্টে দিনাতিপাত করতে থাকেন। ছেলেরা কাছে থাকলেও আলাদা খায়। মেয়ের কাছ থেকে কিছু কিছু সাহায্য পেয়ে তা দিয়েই দিনযাপন করছেন সুরাইয়া। এখন বয়স তাঁর ৬৪ বছর। ডায়াবেটিসে ভুগছেন। প্রতিমাসের চেকআপের টাকার সংকুলান হয় না। সরকারের বীরাঙ্গনা খেতাবের মর্যাদায় ভূষিত সুরাইয়া দাবি করেন এই মর্যাদা সকলের কাছে। বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে বলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চাওয়া তরুণ সমাজের মিশ্র প্রতিক্রিয়াকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা জানে না তাদের বোঝাতে হবে। বীরাঙ্গনা মানে শুধু ঐ নারীদেরই নির্যাতন নয়, সে খারাপ মহিলা নয়। এ তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেশেরই প্রতিভূ। সরকারের কাছে শুধু বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আর জনসমাজের কাছে একটু সম্মানের আকুতি নিয়ে টিকে আছেন সুরাইয়া।
লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো