অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিরন্তর ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ ধরে আসে স্বাধীনতা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই মানচিত্র এদেশের মানুষকে কিনতে হয়েছে অনেক দাম দিয়ে। মূলধারার ইতিহাস সবার ত্যাগের সমান স্বীকৃতি দেয়নি। ইতিহাসের পাতায় নারীর ভূমিকাকে মর্যাদাহীনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যতটা দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল মনযোগ এসব নারীদের প্রাপ্য ছিল, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার তাদের ততটাই অবজ্ঞা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে গেছে পুরুষের বীরত্ব ও নারীর সম্ভ্রমহানির দলিল। তাই এই দলিল অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। যুদ্ধ একটা দেশের মানুষের অস্তিত্বে জড়িয়ে থাকা, চেতনায় মিশে থাকা সামগ্রিক সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দেয়, সেখানে নারী-পুরুষ, ধনী- গরিব, বাঙালি-আদিবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে আলাদা করার সুযোগ নেই। তারামন বিবি রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘বীর প্রতীক’ লাভ করেছেন স্বাধীনতার ২৪ বছর পর। নারী বলেই তাঁর স্বীকৃতির জন্য তাঁকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই সমাজ বাস্তবতায় একজন সাবিত্রী নায়েকের অবস্থান আরও একধাপ নীচে। কারণ তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধি।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারঘাট থানার চানপুর চা বাগানের বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি সাংবাদিক অপূর্ব শর্মার সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে। তিনি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করেছেন। আমিও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করি। তাই আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় চানপুর চা বাগানের বীরাঙ্গনারা। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে থাকি। যোগাযোগ করি হবিগঞ্জের আরেক সাংবাদিক আব্দুল হালিম ভাইয়ের সঙ্গে। তখন তিনি আমাকে এ এলাকার আরো কয়েকজন বীরাঙ্গনার কথাও জানান। হালিম ভাই, কীভাবে যেন জানতে পারেন আমি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে নিজের আগ্রহেই টুকটাক কাজ করি। তাই সানন্দে কথা দেন, আমাকে সাহায্য করার। তাঁর কথামতো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মাসে ঢাকা থেকে বের হই হবিগঞ্জের চা বাগানের পথে। যুদ্ধ কেবল ভূগোল বা ইতিহাস নয়, মানুষের স্বপ্নকেও পাল্টে দেয়, বদলে দেয় জীবন- যাপনের গতিধারা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার চানপুর চা-বাগানের সাবিত্রী নায়েকের জীবনের চেনা ছককে পাল্টে দিয়েছে। বহুবিচিত্র এই সবিত্রীর জীবন। কখনও সে নেশায় বুঁদ, কখনও আত্মভোলা, কখনও উদাসীন- যেন চারপাশে ঘটে যাওয়া কোন কিছুর সাথেই তাঁর কোনো যোগ নেই। হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে ‘উধাও’ হয়ে যান। কোথায় যান কেউ জানে না। ৫-৭ দিন ঘুরেফিরে তিনি আবার তাঁর আস্তানায় ফিরে আসেন। আমরা যেদিন সাবিত্রীর বাড়ি যাই তাঁর একদিন আগেই তিনি ‘উধাও’ হয়ে যান। এখানে-সেখানে যোগাযোগ করে খোঁজ নেওয়া হলেও তাঁর কোনো ঠিকানা জানা যায়নি। অবশেষে বাধ্য হয়েই সাবিত্রীর জীবন জানার জন্য আমাদের বসতে হয় তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। সাবিত্রীর ভাই মঙ্গল নায়েক, ছেলে বড় ছেলে আলম ও ছোট ছেলে খোকনই আমাদের শুনান বীরাঙ্গনাগাঁথা।
সাবিত্রীর ভাই মঙ্গল নায়েক জানান, যুদ্ধের সময় সাবিত্রী ছিল বিশ বছরের এক উচ্ছল তরুণী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সাবিত্রী সবার ছোট। বড় বোন মেরির যুদ্ধের বছর দুয়েক আগে বিয়ে হয় পাশের নলুয়া চা-বাগানে। তাই তখন সাবিত্রীর বিয়ের ব্যাপারে ভাবছিলেন বাবা মধু নায়েক ও মা রমনী নায়েক। সন্তানদের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় সাবিত্রী ছিল খুব আদরের। কিন্তু সবকিছুকে উলট-পালট করে দিয়ে বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা।স্বাধীকারের দাবিতে রাজপথ কেঁপে উঠলে সেই স্পন্দন পাহাড়ি টিলা ও নিবিড় অরণ্য পেরিয়ে পৌঁছে যায় চা-বাগানের নীরব-নিস্তরঙ্গ জনপদে। ১৯৭১ সালের মে-জুন মাসে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে চুনারুঘাটের চানপুর চা- বাগানে। চানপুর বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানি সেনারা চা-বাগানে ক্যাম্প স্থাপন করলে চা-শ্রমিকদের মধ্যে আসন্ন বিপদের আশংকায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। সাবিত্রীও চারপাশের উত্তাপের আঁচ পাচ্ছিলেন। প্রতিদিন লাইন ধরে অসংখ্য মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় সীমান্ত পার হয়ে ভারত যাচ্ছিল। পাকস্তানি সেনাদের ক্যাম্প স্থাপনের পর চা-বাগানে নানা রকম গুজব ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুনা যাচ্ছিল, নানাদিকে মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে পাকিস্তানি আর্মিরা। আশপাশের বিভিন্ন চা বাগানে ও গ্রামে সেনাবাহিনী ঢুকে শ্রমিকদের ও গ্রামবাসীদের নির্বিচারে হত্যা, লুন্ঠন, নির্যাতন ও ধর্ষণ করছে। শহর থেকে মানুষজন যে যেভাবে পারছে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে এমন কথাও সাবিত্রী শুনতে পাচ্ছিলেন। চা বাগানের সবাই তখন চারপাশের এসব ঘটনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতো। সাবিত্রী সবকিছু ঠিকঠাক বুঝতে না পারলেও, সবার এই চাপা আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তা দেখে ভেতরে ভেতরে নিজেও আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক অবস্থানের সাবিত্রী আরও প্রান্তিক হয়ে পড়েন যুদ্ধের নারকীয় বিভীষিকায়।মঙ্গল নায়েক জানান, পাকিস্তানিরা চানপুর চা বাগানে আসছে শুনে এখানকার যুবকরা স্থানীয় চণ্ডিবাজারে অপেক্ষা করতে থাকেন প্রতিরোধের জন্য। দুই নম্বর টার্নিং পয়েন্টে সেদিন অনেকেই জড়ো হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা শাহাজিবাজারের ক্যাম্প থেকে ভিন্ন পথে বাগানে আসে। বাগানে এসে তারা ফ্যাক্টরির গুদামে ক্যাম্প স্থাপন করে।
চানপুর চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন একজন পাকিস্তানি নাগরিক। প্রথমদিকে তারা বাগানের লোকজনকে তেমন কোনো নির্যাতন করতো না। তবে নিয়মিত টহল দিতো এবং বাইরে থেকে লোকজনকে ধরে এনে বাগানের ক্যাম্পে নির্যাতন করতো। তখন বাগানের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। এরমধ্যে দুজনকে হত্যাও করে পাকিস্তানিরা। যদিও পাকিস্তানিরা বাগানে ক্যাম্প করার পর থেকেই শ্রমিকরা কলোনি থেকে যে যেভাবে পারেন পরিবার নিয়ে বাগান ছেড়ে যাচ্ছিলেন। সাবিত্রীর প্রতিবেশী অনেক পরিবারও তখন টেংরাবাড়ি, চিমটি বিল, সাতছড়ি আর তেলিয়াপাড়া সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়।এরকম পরিস্থিতিতে সাবিত্রীর পরিবার মনে করে তাঁরাও বাগান ছেড়ে অন্যদের মতোই ভারতে চলে যাবে। সে অনুযায়ী তাঁরা প্রস্তুতিও নেয়া শুরু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের আর বাগান ছেড়ে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। এই চাপা আতঙ্কের মধ্যেই সাবিত্রী নায়েকের পরিবার বাগানেই থেকে যায়। কারণ, সেসময় সাবিত্রীর ভাই মঙ্গল নায়েক টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে তাঁদের পক্ষে আর অন্যদের মতো ভারতে শরণার্থী হয়ে ওঠা হয় না। আর ভাই মঙ্গল নায়েকের এই অসুস্থতাই সাবিত্রীর জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসে। যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় নারীর ওপর যে ধরনের অমানুষিক ও পাশবিক নির্যাতন হয়, সাবিত্রীকে তার শিকার হতে হয়েছে। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় সাবিত্রীর মাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। বাগান ছাড়ার সময় মঙ্গল নায়েক অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সাবিত্রী ও তাঁর মা বাগানেই থেকে যান। চানপুর চা-বাগানে পাকবাহিনী ক্যাম্প করার কিছুদিনের মধ্যেই তারা সাবিত্রীদের হানা দেয়। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও সাবিত্রী মায়ের পাশে শুয়ে ছিলেন। সাবিত্রীর ঘুম ভাঙ্গে দরজায় প্রচন্ড আঘাতের শব্দে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা দরজা ভেঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। প্রচন্ড ভয় ও আতঙ্কে সাবিত্রী তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরে। পাকসেনারা ঘরে ঢুকে সাবিত্রীকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়। মা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পাঁচজন পাকসেনার সাথে পেরে উঠেননি। আর ভাই মঙ্গল নায়েক তো টাইফয়েডে শয্যাশায়ী। সাবিত্রী ও তাঁর মায়ের চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিলেও সে সময় কেউ এগিয়ে আসেনি।সাবিত্রীকে নিয়ে প্রথমে আটকে রাখে চা-বাগানের ৬ নম্বর বাংলোতে। সেখানে তাঁকে দুই সপ্তাহ আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। দুই সপ্তাহ পর তারা তাঁকে নিয়ে যায় মাধবপুর থানার সুরমা চা-বাগানের বাংলোতে। সেখানে সাবিত্রীর সঙ্গে আরেকটি মেয়েকেও আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো।সাবিত্রী তাঁর এক স্মৃতিচারণায় বলেছেন- ‘যার যখন যেমনে ইচ্ছা তেমনে নির্যাতন করতো। তখন পাকসেনারা জোর করে আমাকে সাদা রঙের একটা বড়ি খাওয়াতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মাধবপুর থানা শত্রুমুক্ত হলে পাকিস্তানি বাহিনী এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
তখন স্থানীয় চা শ্রমিকরা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে চানপুর বাগানে পৌঁছে দেয়।’বাড়ি ফিরে আসে সাবিত্রী। সেই আজন্ম পরিচিত বাগানে, যেখানে সে বেড়ে উঠেছে চারপাশের আলো-হাওয়ার অধিকার নিয়ে। কিন্তু চিরপরিচিত বাগান তাঁর কাছে অপরিচিত হয়ে উঠে। চারপাশের চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে যায়। সে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এতে তাঁর কোনো দায় নেই। কিন্তু সমাজ-সংসার সে সত্যকে স্বীকার করতে রাজি নয়। সমাজ তাঁকে ‘অসতী’ বলে আখ্যা দেয়। নানা বিদ্রুপ, সমালোচনা ও সামাজিক নিগ্রহকে সঙ্গী করে শুরু হয় স্বাধীন দেশে সাবিত্রীর নতুন জীবন। সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মা রমনী নায়েক মেয়েকে বুকে টেনে নেন। লোকজন প্রকাশ্যেই সাবিত্রীকে অপমান করতে থাকে, তাই ক্রমশ তাঁরা একঘরে হয়ে যান। দরিদ্র চা-শ্রমিক পরিবারের পক্ষে সমাজকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকা কঠিন। নিরক্ষর সাবিত্রী ও মঙ্গল নায়েকের জন্য জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই আর্থ-সামাজিক চাপ সাবিত্রীকে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলে কিন্তু বৃদ্ধা মার কথা ভেবে তিনি আত্মহত্যা করেননি। জীবনের এই চরম দুর্দিনে সাবিত্রী বেঁচে থাকার জন্য একটি আলোর রেখার সন্ধান পান।সাবিত্রীর অন্ধকার জীবনে স্বস্তির সুবাতাস নিয়ে এগিয়ে আসেন চানপুর চা-বাগানের মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলী। কেরামত আলী মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখ সমরে যোগ দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চা-বাগানে ফিরে আসেন। কেরামত আলীর ডাকনাম মঞ্জুর, এই নামেই তিনি বাগানে বেশি পরিচিত। বাগানে প্রায় একশ ঘর বিহারি আছে, কেরামত আলীও বিহারি। যুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা যেমন কিছু মানুষকে সুযোগসন্ধানী করেছে তেমনি কিছু মানুষকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্তিও দিয়েছে। চা-বাগানের খেটে খাওয়া এক সাধারণ শ্রমিকের মনোজগতকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা। তাই সবকিছু জেনেশুনেও কেরামত আলী সাবিত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। এই প্রস্তাব সাবিত্রীর কাছে ডুবন্ত মানুষের শেষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরার স্বস্তি নিয়ে আসে। তাই কোনোকিছু চিন্তা না করে তিনি এক কথায় এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান। কিন্তু বাধা হয়ে দেখা দেয় ধর্মীয় পরিচয়। সাবিত্রী সে বাধাও পার হয়ে যান ধর্মান্তরিত হয়ে। সাবিত্রী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।শুধু ধর্মান্তর নয়, সাবিত্রী যেন নবজীবন লাভ করেন এই বিয়ের মাধ্যমে। শুরু হয় রূপকথার নতুন অভিযাত্রা।
যে সমাজে সাবিত্রী বেড়ে উঠেছেন সেখানে সংসার ও ঘরকন্যা নারীর সহজ ও স্বাভাবিক জীবনের অংশ। অনেক দুঃখ কষ্ট ভোগ করার পর সাবিত্রী আশৈশব ও আকৈশোর লালিত স্বপ্নের সন্ধান পায়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের যথার্থতা দেখা দেয় চা-বাগানের প্রান্তিক জনপদে। জীবন চলতে থাকে জীবনের ছন্দে। মানুষ তখনও নানাভাবে উপহাস করত, কিন্তু তখন এই কটূক্তির চেয়ে বড় ছিল জীবনের আনন্দ। বিয়ের দু’বছরের মাথায় সাবিত্রীর ঘর আলো করে আসে পুত্রসন্তান, নাম রাখা হয় আলম। এর তিন বছর পর জন্ম হয় দ্বিতীয় ছেলে খোকনের। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল সাবিত্রীর। ছেলেরা বড় হচ্ছিল আদর-যত্নে, সাবিত্রীর দিনও কাটছিল স্বামীর আদর-সোহাগে।জীবন রূপকথা নয়, জীবন রুক্ষ কঠিন রূঢ় বাস্তবতা। কেরামত আলীর মহানুভবতায় যে রূপকথার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার ঘৃণা ভরা প্রত্যাখানে সেই রূপকথার সমাপ্তি হয়। সমাজ ও চারপাশের মানুষের প্রতিনিয়ত করা ব্যাঙ্গোক্তি একসময় সাহসী মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরোধের দেয়ালও ভেঙ্গে দেয়। তের বছরের সংসার থেকে দু’সন্তানের হাত ধরে বেরিয়ে আসতে হয়। আবার অনিশ্চিত যাত্রা, সামনে বিরূপ পৃথিবী।ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছেন, স্বজাতির মধ্যে কেউ আশ্রয় দেবে না। এ অবস্থায় কোনো উপায় না দেখে ভাই মঙ্গল নায়েকের আশ্রয়ে আসেন। সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা সত্ত্বেও সাবিত্রীকে আবার তাঁর ভাই আশ্রয় দেন। এদিকে সাবিত্রীকে তালাক দিয়ে চানপুর চা-বাগানের সেকশন চৌকিদার কেরামত আলী আবার বিয়ে করেন আশুগঞ্জের এক মেয়েকে। সেই সঙ্গে সন্তানদের দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানায়। যে আলোর দিশা নিয়ে কেরামত আলী সাবিত্রীর জীবনে এসেছিলো, তার চেয়ে বেশি অন্ধকারে তাঁকে ঠেলে দেন। সমাজে তাঁর জন্য কাজ যোগাড় করা কঠিন, ভাইয়ের পক্ষেও তিনটি প্রাণীর খাবার যোগানো কঠিন। কেননা চা-বাগানের প্রায় সকল শ্রমিককেই অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়।
এই দুর্দিনে এগিয়ে আসেন তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি অর্থাৎ কেরামত আলীর মা-বাবা। কেরামত আলীর বাবা নজর আলী মেম্বার ছেলের বউ ও দুই নাতিকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন। শাশুড়ি সুরুজ মনিও তাঁদের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। শ্বশুর-শাশুড়ির আশ্রয়ে থাকার ব্যাবস্থা হয়। অনেক কষ্ট করে তাঁদের খাবার যুগিয়েছেন দুই সন্তানের মুখে। দুই ছেলে এখন চা- বাগানে অস্থায়ী শ্রমিকের কাজ করে এবং তাদের সংসার হয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য সাবিত্রীর পিছু ছাড়েনি। ছেলেদের উপার্জনে তাদের সংসারই ঠিকমতো চলে না।জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়ও তাঁকে আগামীকালের ভাবনায় অস্থির থাকতে হয়। দুঃখ- যন্ত্রণার মহাকাব্য যে জীবন, তার জন্য সুখ ও স্বস্তির স্বপ্ন দেখাই পাপ। তাই সাবিত্রী এই জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ডুব দেন মদের নেশার রঙ্গিন জগতে। কিছুক্ষণের জন্য জাগতিক দুঃখ-কষ্টের উর্ধ্বে উঠে যান। নেশার ঘোর কেটে গেলেই স্মৃতিরা ভিড় করে। যখন স্মৃতি আসে বাগান থেকে বাগানে, ম্যানেজার বাবু কিংবা স্থানীয় সর্দারের কাছে ধরনা দেন স্বীকৃতির দাবিতে। রাষ্ট্র তাঁর সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, স্বীকৃতি হয়তো সাবিত্রীর সেই ক্ষতে কিছুটা সান্ত্বনার পরশ দেবে।
সহায়ক গ্রন্থ ও লেখা
১. বীরাঙ্গনা কথা- অপূর্ব শর্মা (প্রচ্ছদ শিল্পী: অশোক কর্মকার, সাহিত্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি-২০১৩)
২. আসুন বীরাঙ্গনা হীরামনির পাশে দাঁড়াই- কেয়া চৌধুরী। মানবকণ্ঠ, ০৬-২৭-১৪.
৩. মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা জননী/হবিগঞ্জে খোঁজ মিলেছে ১০ বীরাঙ্গনার- আবু সালেহ রনি/ সমকাল ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৩
(বীরাঙ্গনা সাবিত্রীর ভাই মঙ্গল নায়েক, বড় ছেলে আলম ও ছোট ছেলে খোকনের এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের এক বিকালে তাদের চানপুর চা বাগানের বাড়িতে।)লেখক : চন্দন সাহা