পিতা মরহুম ছামাদ মুন্সি এবং মাতা মরহুমা আছিয়া বেগমের চার সন্তানের একজন হলেন সামিনা খাতুন। সিরাজগঞ্জ জেলার সিরাজগঞ্জ উপজেলার ক্লোজার গ্রামে থাকেন তিনি। তাঁর ছোটবেলা কাটে দত্তবাড়ীতে। সেখানেই বড় হয়েছেন। বাবা ব্যবসা করতেন। ফলের ব্যবসা। আম, কাঁঠাল ইত্যাদি। ব্যবসার কাজে ভাইয়েরাও তখন সাহায্য করত। সংসারটা ভালোই চলছিল। যুদ্ধের আগেই তাঁর বাবা মারা যান। যুদ্ধের প্রায় বছরখানেক আগে সামিনা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল। স্বামী শুক্কুর আলী কাজ করতেন ইটের ভাটায়। বাড়ী ছিল সিরাজগঞ্জ সদরের হোসেনপুরে। কাজের খাতিরে তখন বিভিন্ন জায়গায় যেতেন শুক্কুর আলী।
যুদ্ধের সময় তিনি কাজের জন্য ঠাকুরগাঁয়ে গিয়েছিলেন। তাই তখন সামিনা খাতুন বাপের বাড়ী দত্তগ্রামে গিয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জে পাকবাহিনী আসার খবর শুনে সামিনা খাতুন তাঁর পরিবারের সাথে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখতে পান তাঁর বাপের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকবাহিনীরা। পরে জানতে পারেন তাঁর স্বামীর বাড়িও তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
দত্তবাড়ী থেকে পালিয়ে তাঁরা বাগবাটী যান, ছনগাছা যান। এসব জায়গায় তাঁদের কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না। অন্যদের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে থেকেছেন। সেসব গ্রামে প্রায় দুইমাসের মত ছিলেন তাঁরা। এরপর গ্রামের লোকেরা বলেছিল যে পাকবাহিনী চলে গেছে, তাঁরা যেন তাদের নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যায়। সামিনা খাতুন পরিবারের সাথে দত্তবাড়ীতে ফিরে আসেন। পোড়া ঘরবাড়ি ঠিকঠাক করে কোনমতে থাকা শুরু করেন। রাজাকারদের কাছে খবর পান যে শান্তিবাহিনী চলে এসেছে গ্রামে, আর কোন চিন্তা নেই। এ কথা শুনে নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু পাকবাহিনী তখনও চলে যায়নি। তারা আবার ফেরত আসে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অত্যাচার শুরু করে। রাজাকাররাই সামিনার বাপের বাড়ী দেখিয়ে দেয়। ওদের আসতে দেখে সামিনা খাতুন পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। বাড়ির পাশে ইটের ভাটার কাছে দৌড়ে যান। পাকবাহিনী পিছে পিছে দৌড়ে আসে। উপায়ান্তর না দেখে তিনি পুকুরে ঝাঁপ দেন। পাকবাহিনীরা এতে ক্ষান্ত হয় না। বন্দুকের নল দেখিয়ে সামিনা খাতুনকে পানি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। গুলি খাওয়ার ভয়ে সামিনা খাতুন পুকুর থেকে উঠে আসেন। পুকুর পাড়েই শুরু করে অমানবিক অত্যাচার। সামিনা খাতুনের চিৎকার, আহাজারি আর্তনাদ কিছুই কানে তোলে না সেই নরপিশাচ মিলিটারী।পালানোর সময় বাড়ির কেউ সাথে ছিলেন না সামিনার। পাড়ার কয়েকজন বয়স্ক মানুষ ছিলেন। মহিলারা বয়স্ক ছিলেন। ১৩/১৪ বছর বয়সী কিশোরী সামিনা তখন একাই নির্যাতিত হন সেই নরপশুর হাতে। সময়টা ঠিক মনে করতে পারেন না সামিনা। আম কাঁঠালের সময় ছিল। হয়তো জুন-জুলাই মাস হবে। যেসব রাজাকার তাঁদের বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল তাদের কেউ সামিনার পরিচিত ছিল না।
ঘটনার পর সামিনার মা এবং কয়েকজন বয়স্ক মহিলা তাঁকে পুকুর পাড় থেকে উদ্ধার করেন। সামিনা এরপর বাপের বাড়ীতেই ফিরে যান। গ্রামের লোকজন অনেক কথা শুনিয়েছে তাঁকে মিলিটারী দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার কারণে। তাঁকে খারাপ মেয়ে বলে তিরস্কার করেছে। যেন শুধু খারাপ মেয়েদেরই মিলিটারীরা নির্যাতন করে। যুদ্ধের পর সামিনার স্বামী বাড়ী ফিরে আসলে তখন সামিনা হোসেনপুরে গিয়ে থাকেন স্বামীর সাথে। এসময় গ্রামের লোকজন সামিনার নির্যাতনের কথা তাঁর স্বামীর কাছে ফলাও করে বলে। এরপর থেকে শুক্কুর আলী তাঁকে ভালো চোখে দেখতো না। শেষে তিনি সামিনাকে ছেড়ে চলে যান। আর ফিরে আসেননি। পরে সামিনা জানতে পেরেছেন যে শুক্কুর আলী ঠাঁকুরগায়ে থাকেন। আরেকটা বিয়ে করেছেন।সামিনা এখন তাঁর ছেলেদের সঙ্গে থাকেন। তাঁর নিজের কোন থাকার জায়গা বা বাড়ীঘর নেই। সরকারী জায়গায় তাঁর ছেলেরা ঘর তুলেছেন। সেই ঘরেই থাকেন তিনি। তাঁর ছেলে রিক্সা চালায়। সংসারের অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়। এলাকারই এক চেয়ারম্যানের বাসায় সামিনা কাজ করেন। সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে পাঁচশ থেকে ছয়শ টাকা বেতন পান আর খেতে পান। সামিনার বয়স ৫৩/৫৪ হবে। শারীরিক অবস্থাও বিশেষ ভালো না। সারাদিন কাজ করে শরীর ব্যাথায় ভোগেন। ছেলের সংসারে মানুষ কম নয়। তাঁদের সন্তানেরা রয়েছে। তাই কষ্ট হলেও কাজ করার চেষ্টা করেন সামিনা। ছেলের উপর চাপ দিতে চান না। সরকারের কাছ থেকে বীরাঙ্গনা খেতাব পেলেও কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি। একবার ডিসি অফিস থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছিলেন। সরকারের কাছে তিনি শুধু আশ্রয়ের সাহায্য প্রার্থনা করেন। সরকারি জায়গায় ঘর তুলে থাকার কোন নিশ্চয়তা নেই। নিজের বাড়িঘর নেই। ছেলের কাছে থাকাটাও নিশ্চিত না।
সিরাজগঞ্জে যুদ্ধের পর যখন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হয় তখন সামিনা সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি সেলাইয়ের কাজ করতেন। তবে তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকতেন না। সকালে গিয়ে বিকালে চলে আসতেন। তাঁর মত অনেকেই তখন পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করেছে।সামিনা বলেন, সমাজের লোকের কাছে তাঁর মত নির্যাতিত মহিলাদের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। সমাজের কেউই তাঁদের ভালো চোখে দেখে না। তাঁদের খারাপ বলে। তাঁর আক্ষেপ যে সরকার তাঁদের বীরাঙ্গনা বলে খেতাব দিয়েছেন। এতে করে তাঁরা সমাজের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছেন বলে মনে করেন তিনি। সবাই বলে তাঁরা সমাজের কেউ না। তাঁরা বীরাঙ্গনা। যেন এটি মনুষ্যজাতির বাইরের কোনকিছু। সামিনা বলেন যে খেতাব না দিলে তাঁরা হয়তো সমাজের সাথে মিশে থাকতে পারতেন। এখনকার তরুণ সমাজের কারো চোখে তাঁরা ভালো, কারো চোখে তাঁরা খারাপ। নানান মানুষের নানান কথা। বীরাঙ্গনা বলে সমাজের কাছে সম্মানও পান না। তিনি সবার কাছে একটু ভালো ব্যবহার চান। একটু সম্মান আর মর্যাদা চান।
লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো