হাজেরা খাতুনের জন্ম সিরাজগঞ্জের চুনিয়াহাটি কাজিপাড়া উপজেলায়। পিতা মগরব আলী, মায়ের নাম ইসাতন। লেখাপড়া জানেন না। কোনরকমে নামটা সই করতে পারেন, তাও তাঁর মতে ঠিকমতো হয়না। তাঁরা ছিলেন এক ভাই আর এক বোন। পিতার কৃষিকাজ আর কামলার পেশায় তিনবেলা নুন ভাত জুটে যেত। সে হিসেবে সংসারটা ভালই চলছিল।
হাজেরা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল যুদ্ধের কয়েক বছর আগে। স্বামী হাসেম আলীও কৃষিকাজ করতেন এবং অন্যের জমিতে কামলা দিয়ে সংসার চালাতেন। টানাপোড়েন ছিল। হাসেম আলীর বাপের বাড়ি ছিল কান্দা পাড়া। কিন্তু বিয়ের পরেও তাঁরা কিছুদিন পুটুরিয়ায় হাজেরা খাতুনের বাপের বাড়িতে ছিলেন। কাজের অভাব দেখা দিলে যুদ্ধের কিছুদিন আগে তাঁরা পুটুরিয়া থেকে চুনিয়াহাটি গ্রামে যান এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। হাজেরা খাতুনের ছিল দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। যুদ্ধের সময়েও তাঁরা চুনিয়াহাটিতে ছিলেন। তবে পাকিস্তানী আর্মিদের ভয়ে একবার ছাইতানতলি গ্রামে পালিয়ে গিয়ে তিনদিন ছিলেন। সবার কাছে যখন শোনেন যে আর্মিরা নেই তখন আবার নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। ওইসময় সিরাজগঞ্জে আর্মি ক্যাম্প বসেছিল।
আনুমানিক জুন/জুলাই মাসে ছাইতানতলি থেকে নিজ গ্রামে ফেরার পর পাকিস্তানীদের ভয়ে মাটিতে গর্ত করে, গর্তের মুখ বন্ধ করে সেখানে লুকিয়ে থাকতেন হাজেরা খাতুনের পরিবার। এরকমই একদিন তাঁরা লুকিয়ে ছিলেন সেই গর্তে। কোন একটা কাজে কেবল বেরিয়ে এসেছেন গর্ত থেকে। দূর থেকে দেখতে পান কয়েকজন পাকিস্তানী আর্মি আসছে। তাড়াতাড়ি গর্তের মুখ খুলে সেখানে আবার লুকিয়ে যান। কিন্তু তাঁরা বুঝতেও পারেন না যে আর্মিরা তাদের গোপন আস্তানায় ঢোকার দৃশ্য দেখে ফেলেছে। সেসময় হাজেরা খাতুনের স্বামীও গর্তের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন তাঁর সাথে। পাকিস্তানী আর্মিরা গর্তের মধ্যে ঢুকে এসে হাসেম আলীকে টেনে গর্ত থেকে তুলে নেন। নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নেয়া সেই গর্তের ভেতরেই হাজেরা খাতুনকে ধর্ষণ করে তিনজন পাকিস্তানী আর্মি। হাসেম আলী অসুস্থ হয়ে পড়েন এই দৃশ্য দেখে। হাজেরা বেগম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পাকিস্তানী আর্মিরা হাজেরা খাতুনকে ফেলে তাদের ঘর বাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। হাসেম আলী হাজেরা খাতুনের মাথায় পানি ঢেলে তাঁর জ্ঞান ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। নির্যাতনের যন্ত্রণা, অপমান, স্বামীর অসুস্থতা আর পোড়া ঘরবাড়ি নিয়ে অসহায় দিনযাপন করতে থাকেন হাজেরা খাতুন। চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে খাওয়াদাওয়ার কষ্টে ছিলেন। গর্তের ভেতর অল্প কিছু ধান লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলোই ভাঙ্গিয়ে কিছুদিন খেয়েছেন স্বামী সন্তান নিয়ে। এরপর কিছুদিন এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন যারা হাজেরা খাতুনের পাশাপাশি তাঁর স্বামীর চিকিৎসায়ও সাহায্য করেছিলেন।যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সিরাজগঞ্জে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হলে হাজেরা খাতুন সেখানে যান।
তখন সেখানে প্রায় দুই/তিনশো মেয়ে ছিল। তাঁদের কেউ হাজেরা খাতুনের মতই নির্যাতনের স্বীকার, কেউ তাঁদের স্বামী হারিয়ে এখানে এসেছেন। একেক জন একেক ধরনের কাজ করতেন। হাজেরা খাতুন তাঁতের কাজ করতেন। যতদিন পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছিলেন ততদিন ভালোই কেটেছে বলে জানান তিনি। শেখ মুজিবুর রহমান মারা যাবার পর পরই পুনর্বাসন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। সব মেয়েরা যার যার পথে চলে যায়। হাজেরা খাতুনের দুঃখের সময় আবারো ফিরে আসে। যুদ্ধের পরপরই স্বামীকে হারিয়েছেন। পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে ফিরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনমতে দিন কাটাতেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে এক ছেলেকে বিয়ে দেন রায়েরপুর গ্রামে। সেই ছেলের শ্বশুরবাড়িতেই থাকছেন এখন। এ গ্রামেই এক ছেলের সাথে হাজেরা খাতুন তাঁর এক মেয়ের বিয়ে দেন। বিয়ের সময় কিছু দিতে পারেননি ছেলেকে। অনেকের কাছেই অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাঁর এজন্য। কিন্তু কিছু দেবার মত সামর্থ্য না ছিল হাজেরা খাতুনের, না অন্যের রিক্সা চালানো তাঁর দুই ছেলের। নিজেদের রিক্সা হলে হয়তবা একটা গতি হত। সংসারটাও এখন ঠিকমতো চলে না। রোজকার জীবনের টানাপোড়েন নিয়ে ভেবে চলেন হাজেরা খাতুন।বয়সের ভারে নুব্জ্য হাজেরা খাতুন ২৪ বছর বয়সে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ঘটনা স্মরণ করেন। সরকারের দেয়া বীরাঙ্গনার খেতাব পেটের ভাত যোগায় না।
মুক্তিযোদ্ধাদের পাওয়া সুযোগ সুবিধা আর সাহায্যের কথা উল্লেখ করে জানান যে এই বীরাঙ্গনার খেতাব তাঁকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আশ্রয় দেয়নি। কিছু স্বপ্রণোদিত মানুষের স্বেচ্ছা সহযোগিতা পেয়েছেন। সমাজের মানুষেরা ভাল চোখে দেখে না, গালি দেয়। পাকিস্তানী আর্মির বউ নামে ডেকে ধিক্কার দেয়। ছোঁয়াছুঁয়ির অস্পৃশ্যতায় দূরে ঠেলে রাখেন তাঁকে নির্যাতিত মহিলা নামে। দুর্বল শরীরে ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। কাজ করতে পারেন না। টাকার অভাবে ডাক্তারও দেখাতে পারেন না।থাকার জায়গা নেই, পেটে খাবার নেই, সমাজের চোখে অস্পৃশ্য। এই অবস্থার দায় কার তা জানতে চান হাজেরা খাতুন সরকারের কাছে। তাঁর চাওয়া শুধু একটু আশ্রয় আর দুটো ডাল ভাত। দেশের মানুষের কাছে একটু ভাল ব্যবহার কি তাঁর প্রাপ্য নয়?
লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো