হামিদার জন্মের পরেই তাঁর মা মারা যান। মায়ের নাম মর্জিনা। আর কোন ভাইবোন ছিল না হামিদার। বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার মান্দাখোলা গ্রামে। পিতা মরহুম গুনি শেখ পরে দুইবার বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সেই ঘরে কোন সন্তান হয়নি। গুনি শেখ হিন্দু বাড়িতে কাঠ কাটার কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাতেন। হামিদার ছোটবেলা বাবার বাড়ি কান্দাখোলাতেই কাটে। লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধের দুই কি তিন মাস আগে তাঁর বিয়ে হয়। ১৩/১৪ বছর বয়স তখন হামিদার। হামিদার স্বামী মোজাহেদ সয়াধানগড়া গ্রামে অন্যের বাড়িতে থাকতেন। তাঁদের নিজেদের কোন বাড়ি ছিল না। বিয়ের পর হামিদা স্বামীর সাথে সয়াধানগড়া গ্রামে চলে আসেন। মোজাহেদ মজুরের কাজ করতেন, কামলা খাটতেন। তাঁদের সংসারও কোনমতে চলে যেত। যুদ্ধের সময়ে (তখন জুন-জুলাই মাস হবে) গ্রামে পাকবাহিনী আসলে হামিদা ও তাঁর স্বামী পালিয়ে চন্ডিদাসগাতি যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন যে ওই গ্রামেও পাকবাহিনী আগুন লাগিয়েছে। চন্ডিদাসগাতি থেকে পালিয়ে তাঁরা কামারখন্দ থানার হাট পাঙ্গাসি গ্রামে যান। সেখানে কয়েকদিন থাকেন। কিন্তু পাকবাহিনী সেই গ্রামে এসেও আগুন দেয়। ওরা মাইকিং করে যেন সব মানুষজন তাঁদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায়। নাহলে তাঁদের বাড়ি নিলামে তোলা হবে। হামিদারাসহ যারা এরকম পালিয়ে গিয়েছিলেন সবাই এই মাইকিং শোনার পর নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যান।
হামিদা বাড়িতে এসেও দেখেন যে পাকবাহিনী সেখানেও চলে এসেছে। ওদেরকে আসতে দেখে হামিদা ভয় পেয়ে যান। তাঁর সাথে তাঁর দেবরের বউ ছিলেন। হামিদার দেবর তাঁদের দুইজনকে মাটির গর্তে লুকিয়ে রাখেন। সেনারা এসে বাড়ির মুরগি, ছাগল ধরে নিয়ে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পর হামিদা ও তাঁর জা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসেন। সেই রাতেই তাঁদের বাড়িতে রাজাকার আসে। হামিদারা কেবল ভাত খাওয়া শেষ করে রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিছানা করে। রাজাকাররা এসে হামিদার স্বামীকে ধরে ঘরের পাশেই গলিতে বেঁধে রাখে। হামিদাকে ওরা ঘর থেকে বের হতে দেয় না। হামিদা চিৎকার করেন। রাজাকারদের সাথে কোন পাকসেনা ছিল কিনা হামিদা জানতেন না। রাজাকাররা হামিদাকে চিৎকার করতে দেখে মুখের সামনে বন্দুক ধরে চুপ করতে বলে। সারাজীবন যা খাবে তাঁর ব্যবস্থা করে দেবে আশ্বাস দেয়। হামিদার স্বামী হামিদার চিৎকার শোনেন। অন্যান্য বাড়ির মানুষেরাও শোনেন। রাজাকাররা হামিদার উপর নির্যাতন করে চলে গেলে অন্যান্য বাড়ির মানুষজন এসে হামিদাকে জিজ্ঞেস করে তাঁর কি হয়েছে। কেন সে চিৎকার করছে। হামিদার স্বামী এই নির্যাতনের পর আর তাঁকে আর রাখতে চাননা। হামিদা অন্যের বাড়িতে কিছুদিন থাকেন। সেসব বাড়ির মানুষেরা হামিদার স্বামী মোজাহেদকে বোঝান যে যেই ঘটনা ঘটেছে তাতে হামিদার কোন হাত ছিল না। হামিদার নিজ ইচ্ছায় কিছু হয়নি। হামিদা নিজ ইচ্ছায় মোজাহেদের সম্মান নষ্ট করেনি! সবাই বলার পর মোজাহেদ হামিদাকে ঘরে নেন। এর কিছুদিন পরই হামিদার গর্ভে সন্তান আসে। হামিদার কন্যা সন্তান তাঁর পিতার মুখ দেখতে পারেনি। মোজাহেদ কন্যার মুখ দেখার আগেই মারা যান। যুদ্ধের সময় যে ত্রাস তাঁর মাঝে ভর করেছিল সেটাই মোজাহেদের কাল হয়ে দাড়ায়।
যুদ্ধের পর পরই হামিদার স্বামী মারা গিয়েছিলেন। এরপর সিরাজগঞ্জে পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হলে হামিদা সেখানে ভর্তি হন। সেখানে তিনি তাঁতের কাজ করতেন। হামিদার নির্যাতনের পর তাঁর স্বামীই তাঁকে মেনে নিতে পারেননি ঠিকমতো। গ্রামের মানুষদের কথা তো বলাই বাহুল্য। লোকে বলত হামিদা খারাপ মেয়েমানুষ। কেউ বাড়িতে জায়গা দিতে চায়নি। হামিদা এখন তাঁর মেয়ের বাড়িতে থাকেন। মেয়ে আর জামাই ঢাকায় চাকুরি করে। বাড়িতে কেউ নেই থাকার, তাই হামিদা থাকেন সেখানে। একাই থাকেন। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট আছে। একজনকে ধর্ম বোন বানিয়েছেন। সে কিছু চালডাল দেয়, হামিদাও অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজের জন্যে বাকিটা জোগাড় করেন। হামিদার বয়স এখন প্রায় ৫৫ বছর। চোখের সমস্যায় ভুগছেন। নিজের বলতে কোন সহায় সম্পত্তি কিছুই নেই হামিদার। সরকারের বীরাঙ্গনা খেতাবের মর্যাদাটাও কপালে নামেমাত্র লেগে রয়েছে। মানুষের কাছে বীরাঙ্গনা নামে গালি শুনতে হয়। হামিদা মনে করেন খেতাব না পেলে হয়ত সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পারতেন। এই খেতাবের জন্যে সবাই তাঁদের আলাদা করে চিনে গেছে। এই খেতাবের কোন সম্মান তাঁরা পান না। হামিদা এই সমস্যার সমাধান চান সমাজের মানুষের কাছে, সরকারের কাছে।
লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো