সরকার হাসিনাকে বীরাঙ্গনার খেতাব দিয়েছে। সমাজের মানুষের চোখে নিজেকে খারাপ মানুষ হিসেবে দেখতে পেলেও হাসিনা ভাবেন যে এটাতো ভালো যে একটা খেতাব পেয়েছেন তিনি। যদিও এই খেতাবের জন্যে মানুষের গালি খেতে হয়। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মিলিটারির বউ বলে খেপায়। খেতাব না পেলে কি কেউ জানতো হাসিনার নির্যাতনের কথা? কিছু বলত? গালি দিত? হাসিনা এসকল সম্ভাবনার কথা ভেবে দিন কাটান। এসব গালমন্দের কথা প্রশাসনে বলে দেবেন এমনটা আওয়াজ দিলেই লোকের কথা বন্ধ হয়।
হাসিনা বীরাঙ্গনা। একাত্তরে যুদ্ধের সময় নির্যাতিত হন পাকবাহিনীর কাছে। সিরাজগঞ্জের সায়দাবাদে থাকতেন। যেদিন পাকবাহিনীরা তাঁদের গ্রামে আসে, গাড়ির আওয়াজ শুনে হাসিনারা পাশের কাঁদাই গ্রামে পালিয়ে যান। গাড়ি চলে গেলে তাঁরা আবার গ্রামে ফিরে আসেন। সবাই বলতে থাকে মিলিটারিরা আর আসবে না গ্রামে। বাড়িতে এসে হাসিনা তখন রান্না বসিয়েছেন। তখনই চার-পাঁচ জন মিলিটারি বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হাসিনার কোলে তাঁর কন্যাশিশু ভয়ে কাঁদছিল। শিশুটিকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলে। দুজন মিলে হাসিনাকে নির্যাতন করে। সদ্য সন্তান হারা, ধর্ষিত হাসিনা পড়ে থাকেন ঘরের মধ্যে। পাকবাহিনীরা ঘরে আগুন লাগিয়ে চলে যায়। ধোঁয়ায় ঘর ছেয়ে যায়। হাসিনা পড়ে থাকেন।
পাশের বাড়ি থেকে একজন এসে হাসিনাকে উদ্ধার করেন। হাসিনার স্বামী বাড়িতে ফিরে এসে এসব ঘটনা শুনে হাসিনাকে ত্যাগ করে চলে যান তাঁর প্রথম বউয়ের কাছে। হাসিনার স্বামী শোমসের সেখের এটা দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। বিয়ের পরে তাই শোমসের শেখ হাসিনার বাড়িতেই থাকতেন। সেদিন তাঁর প্রথম বউয়ের কাছে ফিরে যান। হাসিনা তাঁর দুসন্তানের একটিকে হারিয়ে অন্যটিকে নিয়ে সেই বাড়িতেই পড়ে থাকেন। যুদ্ধের তিন চার বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর তাঁতের কাজে সংসার খুব একটা খারাপ ছিল না তাঁদের। এখন হাসিনার স্বামী নেই, ঘর-বাড়ি নেই, একটি সন্তানকেও হারিয়েছেন। যখন এই ঘটনা ঘটে তখন জুন বা জুলাই মাস। হাসিনার বয়স হবে ২০/২২ বছরের কাছাকাছি। হাসিনা জানান ক্যাম্পের রাজাকাররা পাকবাহিনীদের তাঁর বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল। ওরা নিজেরা আসেনি। ক্যাম্পের রাজাকাররা মুক্তিবাহিনির গুলিতে মারা যায় পরবর্তী সময়ে।যুদ্ধের পর পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হলে সেখানে ভর্তি হয়ে কাজ শুরু করেন হাসিনা। অনেক ধরনের মানুষ দেখেন সেখানে তিনি। কেউ তাঁরই মতন নির্যাতিতা, কেউ স্বামী হারিয়েছেন। অনেক ধরনের কাজ ছিল পুনর্বাসন কেন্দ্রে। হাসিনা তাঁতের কাজ করতেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করে অনেকেই রাতে থাকতেন সেখানে। কিন্তু হাসিনা বাড়ি ফিরে আসতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মারা যাবার পর পুনর্বাসন কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। হাসিনা তখন লোকের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা শুরু করেন। এখন যদিও বয়সের কারণে তেমন কাজ করতে পারেন না। বয়স ৬০ বছর ছাড়িয়েছে। ছেলের সাথে থাকেন এখন। ছেলের বউ মারা গেছে। তিন নাতি নাতনি নিয়ে আছেন এখন তিনি। হাসিনার ছেলে কৃষি কাজে কামলা দেন। সব সময় কাজ থাকেও না। তখন খাওয়া দাওয়ার খুব কষ্ট যায়। হাসিনার ছোটবেলাও এভাবে অভাবের মধ্যে দিয়ে কেটেছিল। তিন বোন এক ভাইয়ের সংসারে তাঁর বাবার কৃষি কাজ থেকে আসা আয়ে সংসার চলত না। হাসিনাদের ছোট রেখেই তাঁর বাবা মারা গেছিলেন।কোনরকম বয়স্ক ভাতা বা সরকারি সাহায্য পান না হাসিনা। মানুষের কাছে অসম্মানিত হন বীরাঙ্গনা খেতাবের কারণে। কিন্তু এই খেতাবের সম্মান চান তিনি। সরকারের কাছে সাহায্যের দাবি করেন তিনি। মুখে ঘা, দুর্বল শরীর আর নানারকম অসুস্থতা নিয়ে দিনযাপন করছেন হাসিনা। এখন তাঁর বাস, সিরাজগঞ্জের চিনাটি কাজিপাড়া গ্রামে।
লেখক : অনুপমা ইসলাম নিশো