সেদিন নভেম্বরের সন্ধ্যা। শীতের প্রকোপ বেশ। চারদিকে বন, কুয়াশাঘেরা। মাঝখানে ছোট এক চিলতে উঠোন। আদিবাসী বাগদি বাড়ির উঠোন। যেদিকে নারিকেল গাছ, তার বিপরীতে একটা চুলায় ভাত চড়িয়েছেন আশুপদ সরকারের (এই পদবিই এখন ব্যবহার করে পরিবার) মা। নারিকেল গাছের দিকে অন্ধকার, ওদিকে দেউড়ি। বাড়ি থেকে বেরোনোর পথ। উনুনের আগুনের মধ্যে থেকে বনের ফটফট শব্দ বেরোচ্ছে, পাশে গোল হয়ে আশুপদ তাঁর তিন ভাইকে নিয়ে আগুন পোহাচ্ছেন। পরিবারের ছেলেরা সবাই মাছ আর কুঁচো ধরেই পরিবার চালান। বাড়িতে মা, দুই বোন আছে। পিঠেপিঠি বোনেদের বিয়ে হয়নি। পরিবার ছোট নয়। তারমধ্যে আশুপদ বিবাহিত। বিয়ের আট বছরের মধ্যে কোনো বাচ্চাকাচ্ছা হয়নি। আশুপদ ধরেই নিয়েছিলেন আর হবে না। যুদ্ধের মধ্যে প্রথম ছেলেটার জন্ম হয়েছে। ছেলেটার সাত মাস, ঘরে ঘুমাচ্ছে।
এতোক্ষণ ছেলেকে নিয়েই শুয়ে ছিলেন মায়া রাণী, আশুপদের স্ত্রী। উঠোনে আগুন জ্বলতে দেখে বিছানা ছেড়ে আসেন। তাঁর পিছনে পিছনে আসেন ননদ মালা রাণী সরকারও। সবাই মিলে এই যুদ্ধের দিনে আগুন পোহাচ্ছিলেন। পুরুষরা বাজারে গেলে নানা ধরনের খবর পায়। অধিকাংশই যুদ্ধের খবর। বাড়িতে এসে সবাই মিলে নীচুস্বরে সেসব গল্প করে। মায়া রাণী, তাঁর শাশুড়ি আর ননদ শুধু শুনে যান। কোথায় যুদ্ধ হচ্ছে। কোন মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি আসছে, কোন রাজাকার মারা পড়েছে- চারদিকে এসব খবর। চোখের সামনে দিয়ে মিলিটারির গাড়ি চলে যাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই মানুষকে গুলি করে পাখির মতো মেরে ফেলছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কী করবে কোথায় যাওয়ার জায়গা নেই। রাত নামতে থাকে আর যুদ্ধের গল্পও এমুখ-ওমুখ ঘুরে তুঙ্গে উঠে।
এর মধ্যেই নারিকেল গাছের অন্ধকার দিকটায় বড় টর্চলাইটের আলো পড়ে। যারা আগুন পোহাচ্ছিল তাদের উঠে দাঁড়ানোর সময়টুকু দিল না, শা শা করে একসঙ্গে ১০-১২ জন ঢুকে পড়লো। সবার হাতেই বন্দুক। সেখান থেকেই মায়া রাণীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। নিয়ে যাওয়া হলো তাঁর ননদকে। তারপর, মায়া রাণীকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ বেঁধে যায়। কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করা হয়, শহীদ হয় এক মুক্তিযোদ্ধা।
মায়া রাণী সবকিছু হারিয়ে বাড়ি ফিরেন। কিন্তু যে জীবনে তিনি এলেন, সেই জীবনে স্বাদ বলতে কিছু ছিলো না। এক যুদ্ধের দাগ মায়া রাণীকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এর যেন কোথাও শেষ নেই।
মায়া রাণীর জীবনের ছন্দপতন সেই শিশুকাল থেকেই। মানুষ বলে, নারীর জীবন এক ছন্দের ভাঙ্গে, আরেক ছন্দে গড়ে। কিন্ত তাঁর ক্ষেত্রে যেন তা হবার নয়। মায়া রাণীর জন্ম নাটোরের বাগাতিপাড়ায়। থানার সামনেই তাদের বাড়ি ছিলো। আদিবাসী সম্প্রদায়গতভাবে তাঁরা বাগতি, বাবা ভূবন মোহন সরকার আর মা শিবানী দাসীর পাঁচ ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে মায়া রাণীই সবার বড়।ভূবন মোহন সরকার সেই সময়েই এন্ট্রাস পাস ছিলেন। তিনি বাগাতিপাড়া ভূমি কার্যালয়ে কাজ করতেন। নিজের বেশ কিছু জমিজমাও ছিলো। ফলে পরিবার বড় হলেও তাকে খুব একটা বেগ পেতে হতো না। ঘরের চাল কখনো কিনতে হতো না। ভুবন মোহনের আরো এক বড় ভাই ছিলো। তিনি দেশ বিভাগের পর পরই অন্য অনেক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে যান পরিবার নিয়ে।বড় ভাই ভুবন মোহনকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চয়েছিলেন। কিন্তু খুবন মোহন যাননি। এখানেই তাঁর সব। কেন দেশান্তরী হবেন? স্থানীয় বাগদি পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যান মায়া রাণী বাবা।
ভুবন মোহন খুব অল্প বয়েসেই বাত রোগে আক্রান্ত হন। একপর্যায়ে বাতের কারণে পায়ে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, ফলে চলাচল করতে পারতেন না। চিকিৎসক দেখিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি। একপর্যায়ে তিনি একেবারেই অচল হয়ে পড়েন, বাড়িতে বসে যান। এই সময়ে ধীরে ধীরে পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। উপার্জন না থাকায় জমি বিক্রি করেই সংসার চালাতে হতো ভূবন মোহনকে। নিজের জমি তখন খুব অল্প দামে বিক্রি করে দেন তিনি।
মায়া রাণী ছিলেন পরিবারের সবার বড়। এই অবস্থার মধ্যে তাকেই বাজার সদাই করে এনে দিতে হতো। মামাদের বাড়ি ছিলো পাশেই। মামারাই তখন দেখভাল করতেন। মায়া রাণী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় তিনি পড়াশোনা করতেন। সেখানে বাংলার পাশাপাশি তিনি আরবিও পড়েছেন। আবু সরকার নামে একজন হুজুর তাকে পড়াতেন। হুজুরের বাড়িতেই সেই মাদ্রাসাটি ছিলো। মায়া রাণী হুজুরকে দাদু বলে ডাকতেন। পড়াশোনায় একেবারে খারাপ ছিলেন না। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ভূবন মোহন মেয়ে মায়া রাণীকে বিয়ে দিয়ে দেন। তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। মামা রানীর দুর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বিয়ে হয়েছিলো পাবনা আটঘরিয়া থানার দেবোত্তর এলাকায়।তিনিই মায়া রাণীকে নিয়ে এসে খিদিরপুরে বিয়ে দেন। মায়া রাণীর স্বামীর নাম আশুপদ সরকার। তিনি খিদিরপুর এলাকায় দিনমজুরি করতেন। পাশাপাশি মাছও ধরতেন। সাত বছর বয়স থেকে যে সংসার শুরু করেছিলেন মায়া রাণী সেই সংসারও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আর ধরে রাখতে পারেননি।আশুপদ সরকার মায়া রাণীকে ছেড়ে যান। তিনি আরেকটি বিয়ে করেন। মায়া রাণীর পাশেই নতুন সংসার নিয়ে থাকেন আশুপদ।
মায়া রাণীর যখন বিয়ে হয় তখন তিনি বিয়ের কোনোকিছুই বুঝতেন না। স্বামী আশুপদের বয়স ছিলো তখন ১৭-১৮ বছর। শাশুড়িই সংসারের সব কাজকর্ম করতেন। শ্বশুরবাড়ির পরিবারও ছিলো বেশ বড়। মায়া রাণীর চার দেবর আর দুই ননদ। সবাই মিলে ছিলো যৌথ পরিবার। বিয়ে হয়ে গেলেও মায়া রাণীর পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক ছিলো। বাড়িতে একা একাই পড়তেন। সেই সময় বাগদি বাড়ির মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার চল ছিলো না। মায়া রাণীর দুই ননদ ছোট ছোট, তারাও কেউ স্কুলে যায় না। ফলে এভাবে কিছুদিন চললেও শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা আর তার হয়ে উঠে না। ধীরে ধীরে সংসারের কাজেই মন দেন তিনি। বিয়ের আট বছর পর প্রথম বাচ্চা হয় মায়া রাণীর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মায়া রাণীর প্রথম ছেলের বয়স সাত মাস।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেড়শ বাগদি পরিবার খিদিরপুর এলাকায় নিজেদের জমিতেই থাকতো। উপজেলার আরেক গ্রাম রামনগরে আরও প্রায় ২৭টি পরিবার বসবাস করছে। যুদ্ধের সময়ও তারা নিজের ভিটেবাড়ি ছেড়ে কোথাও যায়নি। আটঘরিয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্প গড়ে তুলে। তারা গ্রামে-গঞ্জে স্থানীয় মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলে। খিদিরপুরে এ রকম সংগঠিত রাজাকাররা ছিলো। তারা বন্দুক নিয়ে এলাকা পাহাড়া দিতো আর মাঝে মাঝে পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি করে এসে এলাকার পরিস্থিতি দেখে যেতো।
পাবনা শহর থেকে আটঘরিয়ার খিদিরপুর গ্রাম খুব দূরে নয়। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বাচারে মানুষ হত্যা, পাবনায় কারফিউ জারি করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, মেয়েদের রাজাকাররা সেনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে- এসব খবর বাগদিপাড়ার মানুষের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সন্ধ্যার আগেই মানুষ ঘরে ফিরে। অন্ধকারে দেশকালের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন পুরুষ মানুষেরা। এই অবস্থার মধ্যে অনেক মানুষই দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাগদিপাড়ার মানুষ গরিব, তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। প্রতি দিনরাত তাদের অতঙ্কের মধ্যেই কাটাতে হয়।এর মধ্যেই কখনও সেনারা আসে। তারা গাড়িতে করে সড়ক দিয়ে টহল দেয়। স্থানীয় রাজাকাররা তাদের সহায়তা করে নানা তথ্য দেয়। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের আশপাশে আসলেই নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেনারা চলে গেলে তারা আবার ফিরে আসে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই বাগতিপাড়ার মানুষের এভাবে কেটেছে। শুধু বাগদিপাড়া নয় আশপাশের যত গ্রাম আছে, সবার অবস্থা প্রায় একইরকম। অনেক বাড়ি থেকেই যুবক ছেলেরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতে চলে যায়। তারা ফিরে আসার পর এলাকায় রাজাকারদের উৎপাত কিছুটা কমে আসে। কিন্তু আটঘরিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ঘও হয়।
নভেম্বরের শুরুতে আটঘরিয়া উপজেলার বংশিপাড়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, মারা যায় অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা। এর তিন দিন আগে আটঘরিয়ার চাঁদভা ইউনিয়নের বেরুয়ান গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা একটি রাজাকার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় নয়জন রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে ফেলেন। পরে তাদের মেরে ফেলা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয়। রাজাকার সদস্যদের মেলা ফেলার পর এর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়। বংশিপাড়া চন্দ্রবর্তী নদীর তীরে সেই যুদ্ধ হয়। সেখানে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এইরকম একদিন সন্ধ্যার পর বাড়ির পুরুষরা নিয়ম করেই উঠানে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত পোহাচ্ছিলেন আর যার যার হাতের কিছু কাজ করছিলেন। উঠানে সবাই বসে আছেন। সবাই মিলে গল্প করছে। এর মধ্যে মায়া রাণীর ছেলেটা হঠাৎ করে কেঁদে উঠে। শাশ্বড়ি মায়া রাণীকে তাগাদা দেন বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য। মায়া রাণী তখন ঘরের দিকে যান বাচ্চাকে দুধ দেওয়ার জন্য। বাচ্চাকে দুধ দিয়ে তিনি আবারা উঠানে এসে সবার সঙ্গে গল্প করতে বসেন। উঠানে তখন স্বামী, চার দেবর, দুই ননদ আর শাশুড়ি।
এমন সময় হঠাৎ করেই ১০-১২ জন লোক একসঙ্গে গায়ে চাদর জড়িয়ে উঠানে মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। মায়া রাণী বা অন্যদের বুঝতে অসুবিধা হয় না এরা সবাই রাজাকার। কারণ এদের কয়েকজনকে সবাই চেনেনও। এরা প্রতিবেশী। দলের মূর ব্যক্তি হচ্ছেন মুমিন রাজাকার। এখানকার রাজাকার বাহিনীর প্রধান তিনি। তার নেতৃত্বেই এ এলাকায় বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ছেলেরা রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। সবার কাঁধেই একটা করে রাইফেল।
মায়া রাণীর শাশুড়ি রাজাকারদের দিকে তাকিয়ে বলেন, বাবা তোমারা এখানে কেন এই রাতের বেলা? তখন একজন বন্দুক তাক করে বলে, এই বুড়ি, চুপ থাক। কোনো কথা বলবি না। একেবারে গুলি করে মেরে ফেলবো। তারপর আর ভয়ে শাশুড়ি কোনো কথা বলেননি।
রাজাকাররা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে না থেকে বাড়ির বারান্দা আর উঠানের চারপাশে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে এক ফাঁকে মালা রাণী আর তার বড় বোন ঘরে চলে যায়। কিন্তু তাদের দেখা যাচ্ছে না। হয়তো সেখানে লুকিয়ে আছে। মায়া রাণীকে রাজাকাররা প্রথম থেকেই এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলো যে, তাঁর নড়চড়ার কোনো উপায় ছিলো না।
রাজাকাররা মায়া রাণীর হাত ধরে টান দেয়। মায়া রাণী প্রথমবার নিজের হাত ছাড়িয়ে নেন। তাঁকে বাঁচানোর জন্য তাঁর স্বামী আশুপদ এগিয়ে এলে একজন রাজাকার বন্দুকের বাট দিয়ে তাঁকে জোরে একটা আঘাত করে। আশুপদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় অন্য চার ভাইকেও বন্দুকের নলের মুখে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রাজকাররা। বেঁধে উঠানে ফেলে রাখে। আশুপদকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তারপর চারজনকে একসঙ্গে ব্যাপক পিটুনি দেয় রাজাকাররা। বৃদ্ধ মা সন্তানদের বাঁচাতে গেলে তাঁকে মারধর করে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।এই অবস্থার মধ্যে ঘরের মধ্যে একা মায়া রাণীর ছেলেটা কেঁদে চলেছে, তার কাছে যাওয়ার কেউ নেই।
এবার একজন রাজাকার এসে মায়া রাণীর সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়ায়। তিনি মুখ নিচু করে বসে থাকেন। এবার একজন তাঁর চুল ধরে টান দেয়। তিনি উঠতে বাধ্য হন। মায়া রাণীকে তারা বন্দুকের মুখেই চুল ধরে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায়। মায়া রাণী দেখছেন, ছেলেটা কাঁদছে, কিন্তু কেউ তার কাছে যেতে পারছে না। তাঁকে কেউ ফেরাতে আসছে না। ফটকের কাছে একটা খুঁটি ছিলো, মায়া রাণী সেটিকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেন। একজন রাজাকার এসে রাইফেলের বাট দিয়ে তাঁর হাতে মধ্যে জোরে আঘাত করে। মায়া রাণীর হাত সেই খুঁটি থেকে সরে যায়। তারপরই রাজাকাররা তাঁকে টানতে টানতে বাড়ির পাশের একটি খোলা জায়গায় (এখন যেখানে কলেজ হয়েছে) নিয়ে যায় আর নির্যাতন করে। প্রথম কিছুক্ষণ তিনি নিজেকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই করেন। চিৎকার করেন। কিন্তু কে তাঁকে বাঁচাতে আসবে? এভাবে কতক্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মায়া রাণীর মনে নেই। কারণ তিনি ভয়ে আর নির্যাতনের মুখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে তখন তিনি শুনতে পান পাশে আরেক নারী চিৎকার করছেন। মায়া রাণী বুঝতে পারেন, এটি তাঁর ননদ মালা রাণীর গলা। অর্থাৎ রাজাকাররা তাঁকেও ধরে নিয়ে এসেছে এই খোলা ময়দানে। নির্যাতনের মুখে আবারও জ্ঞান হারান মায়া রাণী। আরও পরে ফের যখন মায়া রাণীর জ্ঞান ফিরে আসে তখন তিনি দেখেন সেখানে এক ভিন্ন পরিস্থিতি।
রাজাকাররা বাড়ি থেকে দুইজন নারীকে তুলে নিয়ে গেছে। একটি গাছের সঙ্গে চারভাইকে একসঙ্গে করে বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে তাদের। দুইজন নারীকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন বাড়িতে আরও এক নারী ছিলেন। কিন্তু তাঁকে দেখতে পায়নি রাজাকাররা। তিনি মায়া রাণীর বড় ননদ। তিনি তখন খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন। ফলে তিনি তখন বেঁচে যান। রাজাকাররা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর মায়া রাণীর শাশুড়ি ছেলেদের মুক্ত করে দেন। ছেলেরা তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? মায়া রাণী বা মালা রাণীকে রাজাকারদের হাত থেকে মুক্ত করার কোনো অবস্থাই তাদের নেই। তারা রাতের অন্ধকারে ছুটলেন পাশের এলাকায় যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা রয়েছে, তাদের কাছে। এই মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার হলেন আনোয়ার হোসেন।
মুমিন রাজাকার যেহেতু মায়া রাণীদের প্রতিবেশী ছিলো, সেই কারণে তার বাবার কাছেও লোকজন গিয়ে ঘটনাটা জানায়। মুমিন রাজাকারের বাবা আবার এসবের মধ্যে ছিলেন না। তিনি ঘটনা শুনে মায়া রাণীদের বাড়ি ছুটে আসেন। সেখান থেকে ঘটনা শুনে যান ছেলের কাছে। ছেলেকে বলেন, দুই নারীকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মুমিন রাজাকার উল্টো বাবাকে চুপ থাকতে বলে।এ সময় কয়েকজন রাজাকার দুই নারীকে ছেড়ে দিতে রাজী হলেও মুমিন তাতে রাজি ছিলো না। পরে অন্য রাজাকাররা এসে মুমিনের বাবাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কমান্ডার আনোয়ার হোসেন রেনু ও শাহজাহান আলী অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বাগদিপাড়ায় আসেন। তারা প্রথমে ফাঁকা গুলি ছুড়ে এবং দুই নারীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। এখানে রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধারা সবাই সবার পরিচিত। একই এলাকার লোক। অন্ধকারে দুইপক্ষ মুখোমুখি হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন অনেক বেশি।শুরু হয় গোলাগুলি। রাজাকার বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধারা পরষ্পর পরষ্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে গুলিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। মুমিনসহ পাঁচজন রাজাকার মারা গেছে। এক সময় রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। আহত অবস্থায় নির্যাতিত দুই নারীকে উদ্ধার করে পরিবারের হাতে তুলে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। মায়া রাণী আর মালা রাণীকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা বাড়ি চলে আসেন।
নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসার পর মায়া রাণীর জীবন আর দশটা সাধারণ নারীর মতো কাটেনি। তাঁকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাড়া করেছে। পরিবার তবু মায়া রাণীকে ফেলে দেয়নি। ঘরে অবিবাহিত ননদ মালা রাণীও নির্যাতিত। ফলে স্বামীর পরিবারের লোকজন তাঁকে খুব একটা কথা বলতো না। কথা বললে তো বোনও বাদ যাবে না মায়া রাণীর স্বামী আশুপদের। স্বামীর সঙসারে মায়া রাণীর দুই ছেলে আর দুই মেয়ে আছে। এখনও তিনি পরিশ্রম করেই ভাত খান। ছেলেদের অভাবের সংসার। নিজের উপার্জনেই তিনি চলেন। থাকার ঘর একটা আছে। কিন্তু ঘর না বলে ছাউনি বলা ভালো।
মায়া রাণীর বড় ছেলের নাম অশোক কুমার সরকার। তিনি বিয়ে করে নাটোরের বনপাড়ায় থাকেন। তাঁর দুই ছেলে রয়েছে। ছোট ছেলে বাবুল কুমার সরকারই মায়ের সঙ্গে থাকেন। তাঁরও দুই ছেলে। বড় মেয়ে অমিতা সরকার। তাঁর বিয়ে হয়েছে বগুড়ায়। তাঁর পাঁচ ছেলে। আর ছোট মেয়ে মনিতা সরকারের বিয়ে হয়ে গেছে একই গ্রামে। তারও দুই ছেলে।
চলতি বছরের ১৭ নভেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাদের এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গেলো বছরের অক্টোবরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে প্রশাসনের। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলো। দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ ৪৫ বছর পর অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেনন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার তিন বীরাঙ্গনা। কিন্তু এখনও তারা কোনো ভাতা পাননি।
তথ্য : ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পাবনার আটোয়ারি উপজেলার খিদিরপুরে মায়া রাণীর সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এই লেখাটি তৈরি হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়