শীতের সকাল-সন্ধ্যার পরিচিত দৃশ্য হলো পরিবারের সকলে মিলে রোদ আর আগুন পোহানো। যুদ্ধ, সহিংসতা, নির্যাতন, মৃত্যু-বিভীষিকার জনপদও মানুষের সহজাত অভ্যাসকে দমিয়ে রাখতে পারে না। তীব্র বিপন্নতার মধ্যেও মানুষ প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই জারি রাখে। পাবনার আটঘরিয়ার খিদিরপুরের বাগদি পরিবারগুলোর জন্যও তা সত্য ছিল। একাত্তরের অস্থির জনপদে তখন কারো হাতেই তেমন কাজ নেই; সেখানে আদিবাসী গরিব বাগদিদের অবস্থা তো আরো করুণ। আশুপদ, সুপদ, নাড়ুপদরা সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরে। বাগদি বাড়ির নিকানো উঠানের এক কোণে নভেম্বরের তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে সবাই মিলে খড়-বিচালি দিয়ে আগুন পোহায়। বাইরের আগুন আর কথাবার্তা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নারীরাও যোগ দেয়।
পুরুষরা বাইরে যায়, তাই নিত্য-নতুন খবর তাদের কানে আসে। একাত্তরের এই সময় অবশ্য সবই যুদ্ধের খবর। নিচুগলায় ফিসফিসিয়ে সবাই এসব খবর বলে। আশপাশের কোন গ্রামে পাকবাহিনী আক্রমন করলো, মুক্তিযোদ্ধারা কোন পর্যন্ত এগিয়েছে, রাজাকাররা কোথায় মারা পড়ছে, এরকম আরো খবর। যুদ্ধের বাজারে কোনটা খবর আর কোনটা গুজব তা নির্ধারণের উপায় নেই। সোনাবালা নীরবে সবকিছুই শোনে যায়। কিছু কিছু বুঝে, অধিকাংশই ধারণা করে উঠতে পারে না… মানুষ কেন মানুষের প্রতি এত নির্মম হবে… সে বুঝতে পারে না।
সোনাবালা সরকার, আশুপদ সরকারের বোন; তাদের বাড়ির চারপাশে বন। সেই সন্ধ্যায় কুয়াশা পড়েছিল বেশ। ছোট্ট নিবিড় ছায়াঘেরা গ্রামের একচিলতে উঠোন রহস্যময় হয়ে উঠছিলো প্রকৃতির আলো-আঁধারিতে। চেনাশুনা চারপাশের মানুষগুলো অচেনা হয়ে উঠছিলো। মুক্তিযুদ্ধে যেমন অনেকে যোগ দিচ্ছিলো অনেকেই তেমনি রাজাকার বাহিনীতেও যোগ দিচ্ছিলো। ভাইয়েরা আলোচনা করছিলো বিভিন্ন গ্রাম থেকে কিশোরী ও যুবতীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে রাজাকাররা। তাদের ঘরেও দুই অবিবাহিত বোন ও আশুপদর বউ মায়ারানী আছে। সবাই মিলেই আগুন পোহাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর পথে দেউটি, এপাশটা কিছুটা অন্ধকার। হঠাৎ করে ওপাশ থেকে একটা বড় টর্চের আলো এসে পড়লো উঠানে। যারা আগুন পোহাচ্ছিল তাদের উঠে দাঁড়ানোর সময়টুকু দিল না, শাঁ শাঁ করে একসঙ্গে ১০-১২ জন ঢুকে পড়লো। সবার হাতেই বন্দুক। সেখান থেকেই সোনাবালাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর যা ঘটে তার কোনো কিছুতেই তাঁর হাত ছিলো না। কিন্তু এ দায় তাঁকে বহন করতে হয়েছে সারাজীবন। ছায়ার মত অনুসরণ করেছে তাঁকে।
পাবনার আটঘরিয়ার খিদিরপুরে দেড়শ বাগদি পরিবার বসবাস করে। তাঁরা নিজেদের জমিতেই থাকে। উপজেলার আরেক গ্রাম রামনগরে আরও প্রায় ২৭টি পরিবার বসবাস করছে। তাদের আদিপেশা কুইচাঁ, কচ্ছপ, মাছ ধরা। তবে গ্রামের কেউ কেউ অন্য পেশার সঙ্গে জড়িত। সোনাবালার বাবা সাধুচরণ বানিয়াত (এখন তারা সরকার পদবি ব্যবহার করে) কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কাজ করেন। তিনি বাড়িতেও যেমন কাঠের কাজ করতেন, তেমনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েও কাজ করতেন। সাধুচরণের পূর্বপুরুষ কোথায় থেকে এখানে এসেছে তা তাঁর জানা নেই। তবে তাঁর বাবা এখানকার বাসিন্দা ছিলেন। সাধুচরণ জন্মের পর থেকে এখানেই বেড়ে উঠেছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই আত্মীয়-স্বজন।সাধুচরণের তিন ছেলে আর দুই মেয়ে। বড় ছেলে আশুপদ সরকার, তার পর সুপদ সরকার, নাড়ুপদ সরকার, অনুপ সরকার। বড় মেয়ের নাম ফুলেশ্বরী সরকার আর ছোট মেয়ে সোনাবালা সরকার। ভাইবোনেরা প্রায় সবাই পিঠেপিঠি।
সাধুচরণকে বেশ কষ্ট করেই সংসার চালাতে হতো। পরিবারের সদস্য তো আর কম না। দারিদ্র্য ছিলো নিত্যসঙ্গী।নিজের স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের মুখে প্রতিবেলা ভাত তুলে দেওয়াই দায়। কিন্তু এই অবস্থার মধ্যেও ননীপদ নামে একটি ছেলেকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন। ছেলেটির গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগর উপজেলার কুচিপাড়া গ্রামে। সেটিও বাগদিদের গ্রাম। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর এতিম ননীপদকে সেখানে দেখার মতো আর কেউ ছিলো না। গ্রামের কেউ এই অনাথ শিশুর দায়িত্ব নিতে রাজী হয়নি। অবশেষে এক আত্মীয়ের সূত্র ধরে ননীপদ চলে আসে সাধুচরণের বাড়িতে। সেখানে থেকেই সাধুচরণের কাছেই কাজ শেখে ননীপদ। সাধুচরণের সাহায্যকারী হিসেবে থাকে। পরিবারের আরো কাজ করে। তার কোনো বেতন নেই, পরিবারের অন্যরা যা খায়, ননীপদও সেটাই খায়। এক সময় সে সাধুচরণের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। এটাই ননীপদর ঠিকানা হয়ে যায়।
সাধুচরণ সরকার ছেলে-মেয়েদের কাউকেই লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। আর সে যুগে সাধারণ মুসলিম পরিবারেই লেখাপড়ার চল ছিলো না, দরিদ্র আদিবাসীদের কাছে তো এসবের বালাই নেই। ৮-১০ বছরের মধ্যে বিয়ে যায় শিশুদের। ফলে সোনাবালারও আর পড়াশোনা হয়নি। বাড়িতে থেকে মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজে সাহায্য করাই তার দায়িত্ব। একটু বড় ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে। সোনাবালা যেহেতু বাড়ির ছোট মেয়ে তার এসব ঝামেলা ছিলো না।
সাধুচরণ সরকার অল্প বয়সেই মারা যান। তখন পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে আশুপদ সরকারের উপর। ঘরে মা, ছোট ছোট ভাইবোন। বোনদের বিয়ে হয়নি। এর মধ্যেই আশুপদ সরকার বিয়ে করেন। সেটা সংগ্রামের আট বছর আগের কথা। বড় ভাইয়ের বিয়ের সময় সোনাবালা একেবারেই ছোট। তারপর বিয়ে হয় ফুলেশ্বরীর। ফুলেশ্বরীরর গ্রামেই বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু বছর ১৫ আগে তিনি পরিবারসহ ভারতে চলে যান। আর মুক্তিযুদ্ধের পর সোনাবালা সরকারের বিয়ে হয় তাদের বাড়িতে থাকা ননীপদ সরকারের সঙ্গে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। সে সময় ননীপদই ছিলেন সোনাবালার একমাত্র অবলম্বন।ননীপদ সরকার বিয়ে না করলে হয়তো সোনাবালাকে কেউ বিয়েই করতো না।
ভাইদের মধ্যে সুপদ সরকার বাবার মতো আসবাবপত্র তৈরির কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে এলাকার বাঙালি হিন্দু-মুসলমান যুবকদের চলাফেরা আছে, অনেকেই বন্ধু-বান্ধব। কাজের সূত্রে, প্রতিবেশী হিসেবে অনেকের সঙ্গে পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন সুপদকে রাজাকাররা ধরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার অপরাধ ছিলো এলাকার বাঙালি মুসলমান যুবক যারা স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। পরে এলাকার অনেক লোকজনকে ধরে পরিবারের সদস্যরা তাকে ছাড়িয়ে আনে। তাকে অবশ্য কোনো নির্যাতন করা হয়নি। তবে এটা ঠিক, সেসময় এলাকার কিছু যুবক গোপনে গোপনে যুদ্ধ শুরু হলে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, মিস্ত্রি হিসেবে তাদেরকে নানা কাজে সহায়তা করতেন সুপদ। সেটা এলাকার অনেক পাকিস্তানপন্থী লোকজন জানত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই এলাকার স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে চলে যায়। সেই সুযোগে রাজাকাররা সুপদকে ধরে নিয়েছিলো।
আটঘরিয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্প গড়ে তুলে। তারা গ্রামে-গঞ্জে স্থানীয় মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলে। খিদিরপুরে এ রকম সংগঠিত রাজাকাররা ছিলো। তারা বন্দুক নিয়ে এলাকা পাহাড়া দিতো আর মাঝে মাঝে পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি করে এসে এলাকার পরিস্থিতি দেখে যেতো।
পাবনা শহর থেকে আটঘরিয়ার খিদিরপুর গ্রাম খুব দূরে নয়। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বাচারে মানুষ হত্যা, পাবনায় কারফিউ জারি করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, মেয়েদের রাজাকাররা সেনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে- এসব খবর বাগদিপাড়ার মানুষের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সন্ধ্যার আগেই মানুষ ঘরে ফিরে। অন্ধকারে দেশকালের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন পুরুষ মানুষেরা। এই অবস্থার মধ্যে অনেক মানুষই দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাগদিপাড়ার মানুষ গরিব, তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। প্রতি দিনরাত তাদের অতঙ্কের মধ্যেই কাটাতে হয়।এর মধ্যেই কখনও সেনারা আসে। তারা গাড়িতে করে সড়ক দিয়ে টহল দেয়। স্থানীয় রাজাকাররা তাদের সহায়তা করে নানা তথ্য দেয়। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের আশপাশে আসলেই নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেনারা চলে গেলে তারা আবার ফিরে আসে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই বাগদিপাড়ার মানুষের এভাবে কেটেছে। শুধু বাগদিপাড়া নয়, আশপাশের যত গ্রাম আছে, সবার অবস্থা প্রায় একইরকম। অনেক বাড়ি থেকেই যুবক ছেলেরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতে চলে যায়। তারা ফিরে আসার পর এলাকায় রাজাকারদের উৎপাত কিছুটা কমে আসে। কিন্তু আটঘরিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ঘও হয়।
নভেম্বরের শুরুতে আটঘরিয়া উপজেলার বংশিপাড়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, মারা যায় অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা। এর তিন দিন আগে আটঘরিয়ার চাঁদভা ইউনিয়নের বেরুয়ান গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা একটি রাজাকার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় নয়জন রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে ফেলেন। পরে তাদের মেরে ফেলা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয়। রাজাকার সদস্যদের মেলা ফেলার পর এর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়। বংশিপাড়া চন্দ্রবর্তী নদীর তীরে সেই যুদ্ধ হয়। সেখানে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
যুদ্ধের সেই ভয়াবহ সময়টাই পেরিয়ে এসেছেন সোনাবালা। মৃত্যুর মতো ছিলো প্রতিটি দিন। এখনো তিনি সেই সন্ধ্যার কথা মনে করে আঁতকে উঠেন। এতো আগের ঘটনা কিন্তু এখনো স্পষ্ট দেখতে পান তিনি। সেদিন সন্ধ্যার পর পরই হঠাৎ করেই ১০-১২ জন লোক একসঙ্গে গায়ে চাদর জড়িয়ে উঠানে মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। সোনবালা বা অন্যদের বুঝতে অসুবিধা হয় না এরা সবাই রাজাকার। কারণ এদের কয়েকজনকে সবাই চেনেনও। এরা প্রতিবেশী। দলের মূল ব্যক্তি হচ্ছে মুমিন রাজাকার। এখানকার রাজাকার বাহিনীর প্রধান তিনি। তার নেতৃত্বেই এ এলাকায় বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ছেলেরা রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। সবার কাঁধেই একটা করে রাইফেল।
সোনাবলার মা রাজাকারদের দিকে তাকিয়ে বলেন, বাবা তোমারা এখানে কেন এই রাতের বেলা? তখন একজন বন্দুক তাক করে বলে, এই বুড়ি, চুপ থাক। কোনো কথা বলবি না। একেবারে গুলি করে মেরে ফেলবো। তারপর আর ভয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি।
রাজাকাররা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে না থেকে বাড়ির বারান্দা আর উঠানের চারপাশে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে এক ফাঁকে সোনাবালা আর তার বড় বোন ফুলেশ্বরী ঘরে চলে যায়। কিন্তু তাদের দেখা যাচ্ছে না। হয়তো সেখানে লুকিয়ে আছে। উঠানে বসে থাকা মায়া রাণীকে রাজাকাররা প্রথম থেকেই এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলো যে, তাঁর নড়চড়ার কোনো উপায় ছিলো না।
রাজাকাররা মায়া রাণীর হাত ধরে টান দেয়। মায়া রাণী প্রথমবার নিজের হাত ছাড়িয়ে নেন। তাঁকে বাঁচানোর জন্য তাঁর স্বামী আশুপদ এগিয়ে এলে একজন রাজাকার বন্দুকের বাট দিয়ে তাঁকে জোরে একটা আঘাত করে। আশুপদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় অন্য চার ভাইকেও বন্দুকের নলের মুখে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রাজকাররা। বেঁধে উঠানে ফেলে রাখে। আশুপদকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তারপর চারজনকে একসঙ্গে ব্যাপক পিটুনি দেয় রাজাকাররা। বৃদ্ধ মা সন্তানদের বাঁচাতে গেলে তাঁকে মারধর করে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।এই অবস্থার মধ্যে ঘরের মধ্যে একা মায়া রাণীর ছেলেটা কেঁদে চলেছে, তার কাছে যাওয়ার কেউ নেই।
রাজাকাররা প্রথমে মায়া রাণীকে টানতে টানতে বাড়ির পাশের একটি খোলা জায়গায় (এখন যেখানে কলেজ হয়েছে) নিয়ে যায় আর নির্যাতন করে। প্রথম কিছুক্ষণ তিনি নিজেকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই করেন। চিৎকার করেন। কিন্তু কে তাঁকে বাঁচাতে আসবে? এভাবে কতক্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মায়া রাণীর মনে নেই।
মায়া রানীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর রাজাকাররা ঘরের মধ্যে ঢুকে। সেই ঘরেই লুকিয়ে ছিলে দুই বোন, ফুলেশ্বরী আর সোনাবালা। রাজাকাররা ঘরের মধ্যে থেকে সোনাবালাকে ভাইদের চোখের সামনে তুলে নিয়ে যায়। ফুলেশ্বরীকে অবশ্য পায়নি তারা। তিনি তখন খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন। ফলে তিনি তখন বেঁচে যান।
রাজাকাররা বাড়ি থেকে দুইজন নারীকে তুলে নিয়ে গেছে। একটি গাছের সঙ্গে চার ভাইকে একসঙ্গে করে বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে তাদের। রাজাকাররা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর মায়া রাণীর শাশুড়ি ছেলেদের মুক্ত করে দেন। ছেলেরা তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? মায়া রাণী বা সোনাবালাকে রাজাকারদের হাত থেকে মুক্ত করার কোনো অবস্থাই তাদের নেই। তারা রাতের অন্ধকারে ছুটলেন পাশের এলাকায় যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা রয়েছে, তাদের কাছে। এই মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার হলেন আনোয়ার হোসেন।
মুমিন রাজাকার যেহেতু সোনাবালাদের প্রতিবেশী ছিলো, সেই কারণে তার বাবার কাছেও লোকজন গিয়ে ঘটনাটা জানায়। মুমিন রাজাকারের বাবা আবার এসবের মধ্যে ছিলেন না। তিনি ঘটনা শুনে সোনাবালাদের বাড়ি ছুটে আসেন। সেখান থেকে ঘটনা শুনে যান ছেলের কাছে। ছেলেকে বলেন, দুই নারীকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মুমিন রাজাকার উল্টো বাবাকে চুপ থাকতে বলে। এ সময় কয়েকজন রাজাকার দুই নারীকে ছেড়ে দিতে রাজী হলেও মুমিন তাতে রাজি ছিলো না। পরে অন্য রাজাকাররা এসে মুমিনের বাবাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কমান্ডার আনোয়ার হোসেন রেনু ও শাহজাহান আলী অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বাগদিপাড়ায় আসেন। তারা প্রথমে ফাঁকা গুলি ছুড়ে এবং দুই নারীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। এখানে রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধারা সবাই সবার পরিচিত। একই এলাকার লোক। অন্ধকারে দুইপক্ষ মুখোমুখি হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন অনেক বেশি।শুরু হয় গোলাগুলি। রাজাকার বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধারা পরষ্পর পরষ্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে গুলিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। মুমিনসহ পাঁচজন রাজাকার মারা গেছে। একসময় রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আহত অবস্থায় নির্যাতিত দুই নারীকে উদ্ধার করে পরিবারের হাতে তুলে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। মায়া রাণী আর সোনাবালাকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা বাড়ি চলে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার নির্যাতিত নারীদের জন্য সারা দেশেই বেশকিছু উদ্যোগ নেয়। বিশেষত নির্যাতিত নারীরা যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে তার জন্য কিছু কুটির শিল্প গড়ে তোলা হয়। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতায় সেগুলো পরিচালনা করা হতো। সে সময় নির্যাতিত নারীরা স্বাভাবিক কারণেই সমাজে ও পরিবারে কোনঠাসা ছিলো। অনেক নির্যাতিতা নারীকে স্বামী ছেড়ে চলে যায়। পরিবারে তাদের স্থান হয়নি। চিকিৎসা জুটেনি। অভাবের তাড়নায় অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন, দেশান্তরী হয়েছেন। পাশের জেলা সিরাজগঞ্জে নির্যাতিত নারীদের জন্য কুটির শিল্পের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পাবনায় তা ছিলো না। ফলে এখানে নির্যাতিত নারীরা ছিলো আরো বেশি অবহেলিত। অবিবাহিত নারীদের জন্য তা ছিলো আরো নাজুক। তাদের বিয়ে করবে কে?
নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসার পর সোনাবালার জীবন আর দশটা সাধারণ নারীর মতো কাটেনি। যুদ্ধ শেষ হলেও সোনাবালার যুদ্ধ যেন শেষ হয় না।তাদের ঘরে দুজন নির্যাতিতা নারী।সোনাবালা অবিবাহিত। নির্যাতনের ঘটনা তাঁদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাড়া করেছে। গ্রামের সবাই এটা জানে। ফলে দুজনের কেউ খুব বেশি একটা প্রতিবেশীদের বাড়িঘরে যান না। বৌদি মায়া রাণীকে পরিবারের লোকজন কোনো কথা শুনায় না। কারণ, তাদের মেয়ে সোনাবালাও তো নির্যাতিত। মায়া রাণীকে বললে সেটা সোনাবালার গায়ে এসেও লাগে। তাহলে মায়া রাণী আর সোনাবালা কি দুজন দুজনের রক্ষাকবচ ছিলেন? মায়া রাণীর পক্ষে সুবিধা ছিলো তার বিয়ে হয়ে গেছে, সন্তান আছে। কিন্তু সোনাবালা তো ভাইদের ঘরে আশ্রিত।তার কী হবে?
মুক্তিযুদ্ধের পর পরই সোনাবালার বড় বোন ফুলেশ্বীরর বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু মায়া রানীকে কেউ বিয়ে করতে রাজি হয় না। মায়া রানী নির্যাতিত এটাই তার বিয়ে না হওয়ার কারণ। মা-ভাইয়েরা এ নিয়ে হতাশায় থাকেন। একসময় গ্রামের মুরুব্বিরা ননীপদের সঙ্গে সোনাবালার বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন আশুপদ সরকারকে। আশুপদ এসে বিষয়টা তার মাকে বলেন। নিজের বাড়িতে আশ্রিত ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে মায়ের প্রথমে কিছুটা আপত্তি ছিলো। কিন্তু এই বিপদের দিনে ননীপদ ছাড়া আর কোনো ভরসাও নেই। ননীপদও কৃতজ্ঞতা বোধের জায়গা থেকে রাজি হয়ে যান। তিনি সহজ-সরল মানুষ। শেষে সবাই মিলে ননীপদের সঙ্গে সোনাবালার বিয়ে দিয়ে দেয়। ননীপদ প্রথম দিকে শ্বশুরবাড়িতে থাকলেও পরে গ্রামেই একটি জায়গায় নিজে বাড়ি করে নেন।
ননীপদ আর সোনাবালার তিনি মেয়ে- সবার বড় মেয়ে জয়ন্তী সরকার, পরে হাসা রানী ও পাশা রানী; আর ছেলে দিলীপ সরকার। এখন সোনাবালা তাঁর ছোট মেয়ে পাশা রানীর কাছেই থাকেন। পাশা রানি গ্রামেই স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। বাবার বাড়ি থেকে দুই-তিন মিনিটের হাঁটা পথ। মেঝ মেয়ে হাসাকে বিয়ে দিয়েছেন নাটোরের বনপাড়ায়। সেখানেও যান মাঝে মাঝে।
চলতি বছরের ১৭ নভেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাদের এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গেলো বছরের অক্টোবরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে প্রশাসনের। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলো। দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ ৪৫ বছর পর অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার তিন বীরাঙ্গনা। কিন্তু এখনও তারা কোনো ভাতা পাননি।
তথ্য : ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পাবনার আটোয়ারি উপজেলার খিদিরপুরে সোনাবালা সরকারের মেয়ে হাসা রাণী সরকারের সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এই লেখাটি তৈরি হয়েছে।
লেখক- চন্দন সাহা রায়